Categories
Blog

প্রকৃতির বিধান

প্রকৃতির বিধানই স্রষ্টার বিধান

প্রকৃতির প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি স্পন্দন—একটি অদৃশ্য ছন্দে বাঁধা। সেই ছন্দের নামই স্রষ্টার বিধান। আকাশের বিশালতা, বৃষ্টির স্নিগ্ধতা, নদীর প্রবাহ, কিংবা মৌমাছির পরিশ্রম—সব কিছুই এক মহান পরিকল্পনার অংশ। কুরআনের আয়াতগুলো এই সত্যের এক অনবদ্য রূপকাব্য; সেখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্রষ্টার কণ্ঠস্বর।

সৃষ্টির বিস্ময় ও প্রজ্ঞা “নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের আবর্তনে, নৌযান চলায় … আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য, যারা চিন্তা করে।”(২:১৬৪)

এ আয়াতে আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, বৃষ্টি, নদী—সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। মানুষের চোখে এগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম, কিন্তু মনের চোখে—এগুলো স্রষ্টার নিদর্শন (আয়াত)।

“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” সূরা আলে ইমরান ৩:১৯০

চিন্তাশীল হৃদয় জানে, প্রকৃতি কেবল জড় বস্তু নয়—এ এক জীবন্ত কিতাব, যেখানে প্রতিটি পাতায় লেখা আছে স্রষ্টার জ্ঞান।

১) বীজ, বৃষ্টি ও জীবনের চক্র

“আল্লাহই শস্য ও বীজ উদ্গত করেন… তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তার দ্বারা উদ্ভিদ জন্মান।” সূরা আন’আম ৬:৯৫

একটি ক্ষুদ্র বীজের ভিতরে যে বিশাল জীবন লুকিয়ে আছে, সেটিও এক মহা-অলৌকিক বিধান। প্রতিটি অঙ্কুরোদ্গম যেন ঘোষণা দেয় “আমি আল্লাহর সৃষ্টি, আমি তাঁর আদেশে জেগে উঠেছি।” “তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় ও চাঁদকে করেছেন উজ্জ্বল, এবং নির্ধারণ করেছেন তার মান।”  সূরা ইউনুস ১০:৫

দিন-রাতের হিসাব, মাস-বছরের চক্র—সবই এক সুসংগঠিত সময়পঞ্জি, যা কেবল এক সর্বজ্ঞ পরিকল্পনাকারীরই হতে পারে।

২) পৃথিবীর ভারসাম্য ও স্থিতি “আল্লাহ আকাশকে স্তম্ভ ছাড়াই উত্তোলন করেছেন … পৃথিবীতে রেখেছেন পাহাড় ও নদী।” সূরা রা’দ ১৩:২

পাহাড়ের দৃঢ়তা, নদীর কোমলতা, আর আকাশের স্থিরতা — সবই প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রতীক। এই ভারসাম্যই মানুষকে টিকিয়ে রাখে, আর প্রতিটি মুহূর্তে বলে দেয় — প্রকৃতির নিয়ম মানে আল্লাহর বিধান।

“তুমি কি দেখ না, আল্লাহ মেঘকে চালনা করেন… তারপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন… এবং আল্লাহ রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটান।” — সূরা নূর ২৪:৪৩

প্রতিটি বৃষ্টিবিন্দু, প্রতিটি মেঘের যাত্রা এক অদৃশ্য নির্দেশে পরিচালিত —বায়ুমণ্ডলের প্রক্রিয়া হলেও এটি আসলে স্রষ্টার ইচ্ছার প্রতিফলন।

৩) জীবজগৎ ও আকাশের সুর “তারা কি আকাশে উড়ছে পাখিগুলো দেখে না? আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদের ধরে রাখে না। সূরা নাহল ১৬:৭৯

একটি পাখির উড্ডয়ন—বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম,কিন্তু হৃদয়ের দৃষ্টিতে এটি স্রষ্টার প্রশংসার সুর।

প্রতিটি ডানার ঝাপটায় যেন বলা হয়,“আমি আছি তাঁর ইচ্ছায়, আমি উড়ি তাঁর নিয়মে।”

৪) মহাবিশ্বের নিখুঁত সংগীত “সূর্য ও চাঁদ নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী চলে… আর তিনি আকাশকে উঁচু করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন।”আর-রহমান ৫৫:৫

সূর্য, চাঁদ, তারা — সবই এক নিখুঁত সিম্ফনির মতো চলছে। বিজ্ঞান একে বলে laws of nature, কিন্তু ঈমানদার বলে

এ আল্লাহর “সুন্নাতুল্লাহ” (অপরিবর্তনীয় নিয়ম)।

“তুমি আল্লাহর রীতি (সুন্নাহ) পরিবর্তন হতে দেখবে না।  সূরা আল-আহযাব ৩৩:৬২

এই স্থিতিশীলতা প্রমাণ করে—বিশৃঙ্খলা নয়, বরং এক পরম বুদ্ধিমত্তা ও পরিকল্পনা মহাবিশ্বকে পরিচালিত করছে।

৫) বিজ্ঞান ও কুরআনের মিলনবিন্দু

বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে কীভাবে জগৎ চলে, কুরআন বলে কেন তা চলে।

* জীবনের উৎস — পানি। “আমি সমস্ত জীবন্ত জিনিস পানি থেকে সৃষ্টি করেছি।”সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৩০

বিজ্ঞানও বলে, জীবনের উৎস পানি—একই সত্য, দুই ভাষায়।

* মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ: “আমি আসমানকে শক্তির দ্বারা নির্মাণ করেছি এবং নিশ্চয়ই আমরা একে সম্প্রসারিত করছি।” সূরা আয-যারিয়াত ৫১:৪৭ আজকের মহাবিশ্বতত্ত্ব এই আয়াতেরই প্রতিধ্বনি।

*পৃথিবীর ভারসাম্য:

“তিনি পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, যাতে তা তোমাদের সাথে দুলে না যায়।”সূরা আন-নাহল ১৬:১৫

ভূবিজ্ঞান এখন জানে—পর্বতই পৃথিবীর স্থিতির মূল ভিত্তি।

উপসংহার: প্রকৃতিতে স্রষ্টার ছায়া। যখন মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখে, তখন সে আল্লাহকে অনুভব করতে শেখে।

তাই বলা যায় — “প্রকৃতির নিয়ামাবলীতে স্রষ্টা মিশে আছেন” তাঁর জ্ঞানে, শক্তিতে, ও প্রজ্ঞায়; কিন্তু সৃষ্টিতে নয়।

প্রকৃতির প্রতিটি নিয়ম এক নিঃশব্দ দোয়া, প্রতিটি পরিবর্তন এক মহা-স্মরণ — যেন মানুষ থেমে চিন্তা করে, এ জগতের মধ্যে স্রষ্টার মুখচ্ছবি দেখে।

By Ekramul hoq

I am A.K.M Ekramul hoq MA.LLB. Rtd Bank Manager & PO of Agrani Bank Ltd. I am interested writing and reading. Lives in Bangladesh, District Jamalpur.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *