দীর্ঘদিন যদি কোন মিথ্যে শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে যায় এবং তার বিপরীত কোন সত্য হাজির না হয়, তবে সে মিথ্যেটাও একদিন সত্যে পরিনত হয় এবং তা মানব হৃদয়ে মজবুদ এক ভিত গেড়ে বসে। সে তখন সে ভিত থেকে আর সড়ে আসতে পারে না, যত সত্যই তার কাছে উপস্থাপন করা হোক না কেন। এবং এই বিশ্বাসের ঘরে কেউ আঘাত করলে তা মেনে নিতে পারে না। এমনকি নিজ সন্তানকেও সে ত্যাগ করতে প্রস্তুত। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া পড়শি, আত্মীয়- স্বজন তো দুরে থাক। তার মনে দীর্ঘ দিনের লালিত সে বিশ্বাসের বিপরীতে কোন সত্যকেও উপস্থাপন করা হলে সে আৎকে উঠে। প্রতিহত করতে চায়,বিরোধিতায় লিপ্ত হয় এমন কি জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। আর সে বিশ্বাস যদি হয় ধর্মীয় – তবে তো আর কথাই নেই। ফলে অনেককে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরও দেখা যায় সে তার গোড়ামীর প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার মুল কারন সত্যটা তার সামনে শুরুতে কোন দিন উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে জাতী একটি হলেও ধর্ম চার হাজার অধিক। কেউ কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত থেকে এক বিন্দু টলাতে সক্ষম নয়। কারন জন্মগত ভাবে সে এ অনুভুতি গুলো দেখে আসতেছে। বহু পুর্ব হতে বাপ-দাদাদেরকেও এরুপই করতে দেখে এসেছে। সে যাকে,যাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে যাকে ইত্তেবা করে তার মুখেও এমনি শুনে এসেছে। তাই তার অন্য কোন কথা, মত কানে পৌছা মাত্র গাজ্বলে উঠে। শোনা বা তা একটু রিভিউ করে দেখা তো দূরে থাক। এমন মানুষদের নিয়ে আল্লাহ ঘোষনা দেনঃ
১] আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদি ও তাদের বাপ দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও। ২ঃ১৭০
২) তারা বলেঃ তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্যে এসেছ যে আমরা এক আল্লাহর এবাদত করি এবং আমাদের বাপ-দাদা যাদের পূজা করত, তাদেরকে ছেড়ে দেই? আরাফ ৭০
তাদের ঈমানের ভিত শক্ত করে রেখেছে সালাতের মধ্যে। রোগ-শোক,বিসন্নতা, ঝড় , জলোচ্ছাস ,যুদ্ধ-বিগ্রহ এমন কি মুমুর্ষ অবস্থাতেও নামাজ পড়তে হবে। এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে ৮০ হুগবা দোজখে বাস করতে হবে। এটাই চির সত্য, বদ্ধমুল বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
আল্লাহ কোরানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আয়াত নাযিল করেছেন, যাতে আমাদের প্রধান ইবাদত যা ধনী-গরীব, সুস্থ- অসুস্থ, মৃত্যু পথ যাত্রী সকল মুসলমানের জন্য সর্ব অবস্থায় মানা ফরজ।
আসলেই কি আল্লাহ এত কঠোরতা আরোপ করেছেন মানুষের উপর? কোরানের আলোকে যাচাই করে দেখি। আমরা যাকে নামাজ বলে জানি কোরানে তা সালাত শব্দে বর্ণিত। ৮০+ জায়গায় বিভিন্ন ভাবে এ সালাত শব্দটি এসেছে। যা আমরা দৈনিক পাচ ওয়াক্ত পড়তে হয় বলে জানি এবং গুরুত্তের সাথে পড়ে থাকি। প্রকৃত কি এই যে প্রচলিত নামাজ আমরা পড়ি আল্লাহ কোরানে যে সালাত কায়েম করার কথা বলেছেন তা প্রকৃত কি এভাবেই, না অন্য কিছু? কোরানের আলোকে দেখে নেই।
আরবী সলাহ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু ফলো করা, বা মুখোমুখি সংযোগ স্থাপন করা এবং মুছাল্লী অর্থ ছায়ার মত অনুসরন করা,। এ বাংলা শব্দ কি ভাবে চয়ন করা হল তা ব্যাখায় জানানো হবে। আকিমুস সলাত মানে কোরানে বর্ণিত আল্লাহর সকল বিধি নিষেধ সর্ব অবস্থায় মেনে নেওয়া,ছায়ার মত লেগে থাকা। যা অনুসরন করা বাধ্যতামুলক।
সুরা কিয়ামাহ আয়াত ৩১ ও ৩২ নং লক্ষ্য করলে তা বুঝা যায়।
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلّٰىۙوَلٰكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰىۙ
সে বিশ্বাস করে নাই এবং নামাজ আদায় করে নাই।বরং সে মিথ্যে বলেছিল এবং মুখ ফিরাইয়া লইয়াছিল।এখানে ছল্লা صَلّٰىۙ ( নামাজ) বিপরীত শব্দ تَوَلّٰىۙ তাওয়াল্লা (মুখ ফিরিয়ে নেওয়া) এবং সদ্দকা صَدَّقَ (সত্য) বিপরীত কাজ্জাব كَذَّبَ (মিথ্যা)
তাওয়াল্লা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে ছল্লা এর অর্থ মুখোমুখি হওয়া বা সংযোগ স্থাপন করা বা অনুসরন করা সঠিক। কিন্তু পারশিয়ান শব্দ নামাজ বসিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মর্ম উপলব্ধিতে ব্যহত করা হয়েছে।
পুর্ব অনুমানের অনুবাদ থেকে বেরিয়ে এসে যদি সঠিক বাংলা অনুবাদ করা হয় তবে উক্ত আয়াতের অনুবাদ হয়ঃ সে সত্য বলে না, অনুসরনও করে না। বরং সে মিথ্যে বলে এবং মুখ ফিরেয়ে নেয়।
সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫, এখানে সালাতের অর্থ নামাজ ধরে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাড়ায় :” আপনি কোরান পড়ুন এবং নামাজ আদায় করুন। নিশ্চয় নামাজ অনৈতিক ও অন্যায় কাজ হতে ফরাইয়া রাখে। “
কিন্তু নামাজ কি নিশ্চিত অনৈতিক ও অন্যায় কাজ হতে ফিরাইয়া রাখতে সক্ষম হয়? একজন মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে একি সাথে অনৈতিক, অন্যায় কাজের সাথে জড়িত হতে পারে। একমাত্র কোরানের নিরবাচ্ছন্ন অনুসরনই একজন মানুষকে অন্যায়, অনৈতিক কাজ থেকে ফিরায়ে রাখতে পারে। তাহলে বুঝা যায় সালাতের অনুবাদ কখনোই নামাজ নয়। সালাতের অনুবাদ রবের ঐশী কমান্ড ছায়ার মত অনুসরন করা। পুর্ন মেনে চলা।
সুতরাং এ আয়াতের যৌক্তিক অনুবাদ হবেঃ” আপনি কোরআন পড়ুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। নিশ্চয় কোরনকে নিরবিচ্ছন্ন অনুসরন অন্যায় অনৈতিক কাজ হতে ফিরাইয়া রাখে। “
উক্ত আয়াতে صَّلٰوةَ সালাত শব্দের অর্থ কখনোই নামাজ হতে পারে না। কারন নামাজ কি আসলেই অন্যায় বা অনৈতিক কাজ হতে ফিরিয়ে রাখতে পারে? একজন মানুষ পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আবার অন্যায়, অনৈতিক কাজও করতে পারে। কিন্তু আয়াতে আল্লাহ বলতেছেন, নিশ্চয় সলাত صَّلٰوةَ অন্যায়, অনৈতিক কাজ হতে ফিরিয়ে রাখে। তাহলে কি আয়াত মিথ্যে ? না। আসলে সালাত صَّلٰوةَ এর ফার্সী অনুবাদ পরিহার করে সঠিক বাংলা শব্দ বসালেই আয়াতের মর্ম বোধগম্য হয়ে উঠে। একমাত্র আল্লাহর আদেশের নিরবাচ্ছন্ন অনুসরন অন্যায় ও অনৈতিক কাজ থেকে একজন মানুষকে ফিরায়ে রাখতে সক্ষম। সুতরাং সালাতের صَّلٰوةَ বাংলা অর্থ আল্লাহর আদেশ ছায়ার মত অনুসরন করা,মেনে চলা বা রবের সাথে মুখোমুখি সংযোগ স্থাপন করা।
অর্থাৎ আপনি আপনার উপর যে কিতাব প্রেরন করা হয়েছে উহা পড়ুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। নিশ্চয় নিরাবচ্ছন্ন (কোরানের আদেশ) অনুসরন অন্যায় ও অনৈতিক কাজ হতে ফিরায়ে রাখে।
সালাতের صَّلٰوةَ অর্থ যদি আল্লাহর সকল আদেশ নিষেধ নিরবচ্ছন মেনে নেয়া বুঝায় তবে নিঃসন্দেহে সালাতই হবে বেহেস্তের চাবী। নামাজ অর্থে বেহেস্তের চাবী হতে পারে না। তাহলে তো কোরানে বাকী আয়াতগুলি অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় গন্য হয়। কোন দরকার ছিল না।
উহাদের পরে আসিল অপদার্থ পরবর্তীরা, তাহারা সালাত নষ্ট করিল ও লালসা-পরবশ হইল। সুতরাং উহারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করিবে, কিন্তু উহারা নহে-যাহারা তওবা করিয়াছে, ঈমান আনিয়াছে ও সৎকর্ম করিয়াছে। উহারা তো জান্নাতে প্রবেশ করিবে। উহাদের প্রতি কোন জুলুম করা হইবে না। (১৯:৫৯-৬০)এখানে صَّلٰوةَ মানে রবের কমান্ডা অনুসরন অর্থাৎ কোরানের সকল আদেশ নিরবাচ্ছন্ন অনুসরন অনুবাদ করলে আয়াতের মর্ম সঠিক ভাবে উপলবদ্ধি করা যায়। নচেৎ বুঝাবে আগে নামাজ একরকম ছিল পরে তা কোন দল বা গোষ্ঠি পরিবর্তন করে ফেলেছে।
তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ্কে সিজদা করে যাহা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে ? আবার অনেকের প্রতি অবধারিত হইয়াছে শাস্তি। আল্লাহ্ যাহাকে হেয় করেন তাহার সম্মানদাতা কেহই নাই; আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন। সূরা নম্বরঃ ২২, আয়াত ১৮
এ আয়াত অনুযায়ী তারকা,গাছপালা,চন্দ্র,সূর্য, পর্বতরাজী, এমন কি জীবজন্তুও আল্লাহকে সিজদা কি ভাবে করে? আল্লাহর প্রদত্ত বিধান মত কার্য সম্পাদনকেই সিজদা বুঝিয়েছে। আল্লাহকে সিজদা করা মানে আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পন করা।
সূরা নাহল ৪৯ ও ৫০ নং আয়াতঃ
আল্লাহ্কেই সিজদা করে যাহা কিছু আছে আকাশ মণ্ডলীতে, পৃথিবীতে যত জীবজন্তু আছে সে সমস্ত এবং ফিরিশতাগণও, উহারা অহংকার করে না।