প্রথমে পুরো আয়াতটি পড়ুন: কুরআনের আয়াত তার প্রসঙ্গ সহকারে পড়ুন , প্রসঙ্গ ছাড়া নয়। বোঝার চেষ্টা করুন আয়াতটি নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য নাকি সমগ্র মানব জাতির জন্য , নির্দেশ বা উপদেশ মূলক নাকি শিক্ষামুলক কাহিনি বা বর্ননা ইত্যাদি।
২) অধিকাংশ মুসলমান কুরআনের অর্থ না জেনেই পড়েন। কারণ আজকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এটা মেনে নিয়েছে যে, কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা তেলাওয়াত করতে হয় শুধুমাত্র “সোয়াব” অর্জনের জন্য, যদিও কুরআনে কোথাও বলা হয়নি শুধুমাত্র সওয়াব অর্জনের জন্য পাঠ কর। এর ফলে কুরআন তিলাওয়াত/পড়া হয় শুধুমাত্র নামাজ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাত, মাস, জানাজা ইত্যাদির জন্য। কীভাবে এর শুরু হয়েছিল এবং কী উপায়ে কুরআনকে পিছনে ফেলে হাদিস বা ধর্মীয় পণ্ডিতদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল এবং লোকেরা কুরআনের পথ থেকে বেরিয়ে এসেছিল , তা একটি দীর্ঘ ইতিহাস।
১) ভাষা: আমরা বেশিরভাগই আরবি ভাষা জানি না, যদিও আমরা কেবল কুরআনের অর্থ না জেনেই কেবল পড়তে জানি (আমিও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম)। সুতরাং, যদি আরবি শিখতে পারি তবে ভাল, আর যদি না পারি তবে আমাদের কুরআনের অনুবাদের সন্ধান করা উচিৎ। তাই আমাকে/আপনাকে অনুবাদের জন্য যেতে হবে। কিন্তু,বড় প্রশ্ন কোন অনুবাদ? একটি মাত্র আরবি কুরআন থাকলেও একই ভাষায় অসংখ্য অনুবাদ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলা ভাষায়, আপনি কম করে হলেও ৬ ধরনের অনুবাদ পাবেন। ইংরেজিতে অনুবাদের সংখ্যা অগণিত।সুতরাং, কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? যেহেতু একটি মাত্র আরবি কুরআন আছে, তাই সব অনুবাদ কি একই হওয়া উচিত নয়? উত্তর হল- ইচ্ছা থাকলেও একই হবে না। এর পেছনের কারণ হল, অনুবাদ মানুষের করা। তাই আপনি নিশ্চিত না হলে অন্তত তিন বা চারটি অনুবাদ চেষ্টা করুন। আর ও ভাল হয় যদি প্রতিটি আরবি শব্দের মানে জানার চেষ্টা করেন।
২) পবিত্র কুরআনের সম্পুর্ন আধিপত্য:যেই মাত্র আমরা স্বীকার করব যে পবিত্র কুরআন প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি ব্যাখ্যা সহ নাযিল হয়েছে , তখনই এটা পানির মত পরিস্কার হয়ে যাবে যে আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যার জন্য সম্মিলিত হাদীস বা স্বীকৃত শরিয়াহ মতামত বা সন্দেহজনক মনুষ্যনির্মিত তাফসীরের প্রয়োজন নেই।
৩) সাধারন মানুষ কুরআন পড়ে না বা পড়লেও বোঝার চেষ্টা করে না। ফলে জানেই না , যা কুরআনে নেই তা ইসলাম নয়। সমস্যা হ’ল লোকেরা খুব কমই ধর্মীয় সমাধানের জন্য কুরআনের দিকে নজর রাখে , বরং এটির জন্য ধর্মান্ধ মোল্লাদের উপর নির্ভর করে।
বেশিরভাগ মুসলমান পবিত্র কুরআনকে এক ধরণের রহস্যময় বা সাংকেতিক বই হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তাদের ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে যে মনুষ্য নির্মিত হাদীস দিয়ে। বদ্ধমুল ধারনা সৃষ্টি করা হয়েছে যে হাদীস বা তাফসীর না জানলে কুরআনে বিবৃত আল্লাহর বাণী উপলব্ধি করা বা বোঝা যাবে না বা বুঝে সেই মতো আমল করলে পাপ হবে। এই কল্পকাহিনীটি সময়ের সাথে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রচার করা হয়েছে। কুরআন কেবল বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, সাধারণ মানুষ বা তাদের চিন্তাভাবনা দ্বারা নয়। তাদের এই বিকৃত ব্র্যান্ডের ইসলামকে অন্ধভাবে মেনে চলার মাধ্যমে, বেশিরভাগ মুসলমান আল্লাহর কুরআনে মনোযোগ দেয় না।
৪) কুরআন বুঝতে হলে.সুস্পষ্ট আয়াত গুলি আগে পড়ে নিতে হবে। কারন কুরআনের আয়াতগুলি একে অপরের উপর আলোকপাত করে এবং ব্যাখ্যা করে: “যারা আমার নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং পথনির্দেশ মানুষের জন্য কিতাবে সুস্পষ্ট করার পরও গোপন করে, তাদের উপর আল্লাহর লানত এবং অভিসম্পাতকারীগণের ও অভিসম্পাত।” (২:১৫৯)।
কিতাবকে আল্লাহ নিজেই সুস্পষ্ট করেছেন। আমাদের মানুষদের একটাই কাজ – কিতাব পড়া এবং গভীরভাবে চিন্তা করা। আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে নিম্নলিখিত বলেছেন: “আমরা কুরআনকে স্মরণ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। কেউ কি আছে যে স্মরণ করবে?” (৫৪:২২)
আহলে কিতাব সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল: “তোমরা এটা লোকদের কাছে প্রচার করবে, গোপন করবে না।” কিন্তু তারা তাদের পিঠের পিছনে তা ফেলে রাখল এবং সামান্য মূল্যে তা বিনিময় করেছে। কী নিকৃষ্ট বিনিময় তারা করেছে।” (৩:১৮৭)। এই আয়াতটিতে আহলে কিতাবদের অর্থাৎ ইহুদি খৃষ্টানদের কথা বলে আল্লাহ আমাদের, যাদেরকে কুরআন (কিতাব) দেয়া হয়েছে, সাবধান করছেন । আমাদের হুজুররা কি এই সাবধান বাণী স্মরনে রেখেছেন বা এই আয়াত থেকে কোন শিক্ষা নিয়েছেন?
কুরআনের আয়াতগুলি অস্পষ্ট এবং এর ব্যাখ্যার জন্য তাফসীর বা হাদীসের প্রয়োজন যারা বলে থাকে , কুরআনের এই আয়াত দ্বারা তা খণ্ডন করা হয়েছে:”তারা আপনার কাছে যে যুক্তিই নিয়ে আসুক না কেন, আমরা আপনাকে সত্য এবং আরও ভাল ব্যাখ্যা (তাফসির تَفْسِيرًا ) প্রদান করি।” (২৫:৩৩)। কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যাটি এর পাঠ্যের মধ্যেই রয়েছে, কারণ এর আয়াতগুলি একে অপরের উপর আলোকপাত করে এবং একে অপরের বিশদ বর্ণনা প্রদান করে।
কুরআনিক এই সত্যটি এই আয়াত দ্বারা দৃঢ় করা হয়েছে:”…আমরা আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা সমস্ত কিছুর ব্যাখ্যা এবং হেদায়েত, রহমত ও সুসংবাদ তাদের জন্য যারা আনুগত্য করে।” (১৬:৮৯)। সুতরাং, যেহেতু কোরানের আয়াতগুলি একে অপরকে ব্যাখ্যা করে এবং আমাদের আল্লাহর ধর্ম সম্পর্কে যা জানা দরকার তা স্পষ্টভাবে বলে , সেহেতু কোরানের পাঠে ছলচাতুরী, অপ্রয়োজনীয়তা, শব্দচ্যুতি বা শব্দচয়নের কোন স্থান নেই এবং কুরআনের ‘ব্যাখ্যা’ করার জন্য আমাদের কখনই বাইরের উৎসের প্রয়োজন হয় না। এই আয়াত অনুসারে কুরআনই আমাদের গাইড করার জন্য আল্লাহর রহমতের অংশ। যারা প্রভু আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশনা অন্বেষণ করে আন্তরিক ভাবে কুরআন অধ্যয়ন করে , তারা করুণা লাভ করবে এবং হেদায়েত পাবে।
পবিত্র কুরআন বোঝার অন্যতম শর্ত জ্ঞান চর্চা: কুরআন বুঝতে হলে শুধু বিশ্বাস করলে হবে না , জ্ঞান চর্চাও করা লাগবে ; অর্থাৎ চিন্তা ভাবনা করতে হবে। কোরানের আয়াতগুলি সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট, এবং একটি স্পষ্ট অর্থ সহ নাযিল হয়েছে। কোরানের আয়াতগুলি একে অপরকে ব্যাখ্যা করে এবং এই সত্যটি আমরা এই আয়াতগুলি থেকে অনুমান করতে পারি: “একটি কিতাব যার আয়াতগুলি নিখুঁত করা হয়েছিল, তারপর বিশদ বর্ণনা করা হয়েছিল এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে” (১১:১); “একটি আরবি কুরআন, কোন ত্রুটি ছাড়া, যাতে তারা ধার্মিক হতে পারে।”
“নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন কর।” (৬:১৫৩); “তারা কি কোরান নিয়ে চিন্তা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এতে অনেক অমিল পেত।” (৪:৮২)।
চিন্তা-ভাবনা করা- ২৩:৬৮ “অতএব তারা কি এই কালাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি?”</p>