নবীর যুগে সালাত কেমন ছিল?
এ বিষয় বুঝতে হলে টাইম ট্রাভেলিং এ ১৪০০ বছর আগে যেতে পারি অথবা বর্তমান সময়ে কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করে সুরা নেসার ৮২ নং এবং সুরা মোহম্মদের ২৪ নম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেছেন তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না, গবেষনা করে না? না কি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? তবে কি উহারা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? না উহাদের অন্তর তালাবদ্ধ?( ৪৭:২৪)
ধরুন আপনি কলকাতা শহরে আছেন। হঠাৎ কোন এক গভীর রজনীতে জিব্রাইল এসে সেই হেরা গুহার মত একাকী আপনাকে বলল আল্লাহ আপনাকে রাসুল হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং আপনাকে আরো ২৩ বছর আয়ু প্রদান করেছেন এবং সারে ছয় হাজার আয়াত আপনার উপর নাযিল করা হবে। আপনার দায়িত্ত হল এই আয়াত গুলো কলকাতা তথা সমগ্র ভারতের সবার কাছে পৌছে দেওয়া।
বর্তমান যোগ হলে আপনি কিভাবে পৌঁছে দিতেন,? সুরা মায়েদার ৯২ এবং ৯৯ আয়াতে জানি রাসুলের মুল কাজ হচ্ছে আল্লাহর বাণী গুলো পৌঁছে দেওয়া।
যদি তোমরা মুখ ফিরাইয়া নেও তবে জানিয়া রাখ, স্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য। [ ৫:৯২]
প্রচার করাই কেবল রাসূলের কর্তব্য। [ ৫:৯৯]
বর্তমান সময় অনুযায়ী আপনি হয়ত ফেইসবুক, হোয়াটস আপ, মেসেঞ্জার, মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে বাণী গুলো সবার কাছে পৌছে দিয়ে আপনার দায়িত্ত পালন করতেন।
কিন্ত আমরা যদি ১৪০০ বছর আগের টাইম ট্রাভেলের কনটেক্সট এ চিন্তা করি তখন কিন্ত ফেইসবুেক, হোয়াটসআপ, মোবাইল কিছুই ছিলনা, প্রচারের জন্য এমন কোন মিডিয়া প্লাটফর্ম ছিল না। সেই সময়টার কথা একটু ভাবেন, যখন কাগজ পর্যন্ত আবিস্কার হয় নি। এমন না জিব্রাইল ফোন করে বলবেন হে আল্লার রাসুল আজ রাত তিনটার সময় ১০ টি আয়াত নাযিল করব, যেহেতু আপনি পড়া লিখা জানেন না, তাই আপনি আপনার ওহী লিখকদের কাগজ কলম নিয়ে প্রস্তুত রাখবেন, পড়ে না হয় তা সবার কাছে পৌঁছে দিবেন।
সূরা বাকারার ৯৭ আয়াতে জানি জিব্রাইল ফেরেস্তা ঐ ভাবে আসতেন না। তিনি আসতেন আল্লার রাসুলের অন্তরে কলবে। সেখানে এই কোরআনের আয়াত গুলো নাযিল হত।
বল, সে আল্লাহ্র নির্দেশে তোমার হৃদয়ে কুরআন পৌঁছাইয়া দিয়াছে, [ ২:৯৭ ]
রাস্তা ঘাট বা যানবাহন ও এত সহজ লভ্য ছিল না যে তিনি এই সমগ্র হেজাজে ঘুরে ঘুরে সবার কাছে আয়াত গুলি পৌঁছাতেন। মাত্র ২৩ বছরে প্রায় সারে ছয় হাজার আয়াত পৌছে দিতে হয়েছে। কি ভাবে তা সম্ভব হতো? এ বিষয়টা একটু চিন্তা করুন। তারপর সমাধান বলছি। তার মাঝে আরেকটি বলে বিষয় বলে নেই যা এটা বুঝতে সহজ হবে।
যখন আদম ও হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের করে দিলেন, পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন তখন তারা বড় কস্ট পেয়ে ছটফট করছিলেন। তখন আল্লাহ তাদের একটি সুসংবাদ জানিয়েছিলেন। তা ছিল এই তোমাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে হেদায়েত যাবে যদি তোমরা তা অনুসরন কর তবে পুনরায় জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে। সুরা বাকারার ৪৮ নম্বার আয়তে যা বর্ণিত।
আমি বলিলাম, ‘তোমরা সকলেই এই স্থান হইতে নামিয়া যাও। পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসিবে তখন যাহারা আমার সৎপথের নির্দেশ অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না।’ [ ২:৩৮]
ঐ হেদায়েত যে বিশ্বাস করবে এমনটি নয়। বরং ঐ হেদায়েত যে অনুসরন করবে তাদের কোন ভয় নেই। মানে তারা আবার রিটার্ন করতে পারবে এই জান্নাতে। ভাল করে লক্ষ্য করুন এখানে বিশ্বাস নয় অনুসরন করতে বলেছেন আল্লাহ। প্রশ্ন হচ্ছে সেই হেদায়েতটা কি? সুরা বাকারার ২ নং আয়াতে আল্লাহ তা বলে দিলেন।
ইহা সেই কিতাব; ইহাতে কোন সন্দেহ নাই, মুত্তাকীদের জন্য ইহা পথ – নির্দেশ,[ ২:২ ]
এই কোরানই হচ্ছে সেই হেদায়েত। তবে সবার জন্য নয়। কাদের জন্য মোত্তাকীদের জন্য। মোত্তাকী হচ্ছে মুসলিম ও মোমিনের উর্ধে টপ গ্রেড ফরম। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যদাবান মানুষই হচ্ছে মোত্তাকী। সুরা হুজরাতের ১৩ নাম্বার আয়াতে তার বর্ননা।
হে মানুষ ! তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্র নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।
মোত্তাকী হতে গেলে ১৫/২০টা কোয়ালিটি অর্জন করতে হয়। তাহলে আমরা মোত্তাকীতে উপনিত না হতে পারলেও কিভাবে পেতে পারি ঐ হেদায়েত। তার জবাব আল্লাহ দিচ্ছেন সূরা যুমারের ১৮ নম্বার আয়াতে।
যাহারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং উহার মধ্যে যাহা উত্তম তাহা গ্রহণ করে। উহাদেরকে আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং উহারাই বোধশক্তি সম্পন্ন [৩৯:১৮]
তার মানে আমরা যদি মোত্তাকী না হতে পারি যদি সাধারন মানুষও হই আর কোরানের কথা মনযোগ সহকারে শুনি এবং তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহন করি তাহলেও হেদায়েত পাব। এটা আল্লাহর ঘোষনা।
কি সেই হেদায়েত? সুরা বাকারার ১৮৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেনঃ
রামাযান মাস, ইহাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্য কারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হইয়াছ। [২:১৮৫]
এই কোরানই হচ্ছে আদম হাওয়াকে বলা হেদায়েত। এই কোরআনকে যদি আমরা অনুসরন করি তাহলে আমরা আবার জান্নাতে রিটার্ণ ব্যাক করতে পারবো।
এই যে কোরআন ! আমাদের জন্য হেদায়েত, এই কোরআন তেইশ বছর ধরে পর্যায় ক্রমে রাসুলের উপর নাযিল করেছেন, আর রাসুল দায়িত্ব হচ্ছে সূরা মায়েদার ৯৯ নাম্বার আয়াত অনুযায়ী তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া।
প্রচার করাই কেবল রাসূলের কর্তব্য। আর তোমরা যাহা প্রকাশ কর ও গোপন রাখ আল্লাহ্ তাহা জানেন।[৫:৯৯]
তিনি কি ভাবে পৌঁছে দিয়েছিলেন? যে যুগে মোবাইল নেই, টেলিফোন নেই, কাগজ নেই, সোসাল মিডিয়া নেই সহজ লভ্য কোন যানবাহনও ছিল না। এটা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলেই আমরা নবী- রাসুলের যুগে সালাত কেমন ছিল তা সহজে উপলব্ধি করতে পারব।
সূরা নামলের ৯২ নাম্বার আয়াতে বর্নিত হয়েছেঃ আমি আরও আদিষ্ট হইয়াছি, কুরআন তিলাওয়াত করিতে; [২৭:৯২]
আবার সূরা মোজাম্মেল ৪ নাম্বার আয়াতে নির্দেশ দেনঃ আর কুরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে;[৭৩:৪]
কাজেই তোমরা কুরআন হইতে যতটুকু সহজসাধ্য আবৃত্তি কর। অতপর সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর [ ৭৩:২০ ]
উক্ত আয়াতে কি বলা হচ্ছে? আগে বলা হচ্ছে যে কোরআন থেকে তেলওয়াত কর তারপর বলা হচ্ছে যে সালাত কায়েম কর।
সূরা আনকাবুত ২৯ নাম্বার আয়াতঃ তুমি আবৃত্তি কর কিতাব হইতে যাহা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। অতপর সালাত কায়েম কর। [ ২৯:৪৫ ]
এখানেও একি ভাবে বলছেন তুমি কোরান থেকে আবৃতি কর যাহা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে সালাত কায়েম কর। কিন্তু কেন? আমরা তো জানি প্রচলিত সালাতে কোরান তেলোয়াত করা হয়। তাহলে কোরান তেলোয়াত করার পর আবার আলাদা ভাবে সালাত কায়েম এর কথা বলছেন কেন আল্লাহ ?
সুরা ফাতির আয়াত ২৯। আল্লাহ বলছেনঃ যাহারা আল্লাহ্র কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাহাদেরকে যে রিযিক দিয়াছি তাহা হইতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাহারাই আশা করে এমন ব্যবসায়ের, যাহার ক্ষয় নাই। [ ৩৫:২৯ ]
এখানেও আমরা দেখছি আল্লাহর কিতাব অধ্যয়নের পর আলাদাভাবে সালাতের কথা বলা হয়েছে । তার মানে আকিমুস সালাত আর নামাজ এক নয়। কোরআন তেলোয়াত আর সালাত কায়েম এক বিষয় নয়।
এবার বুঝতে সহজ হবে নবী রাসুল গন কি ভাবে সালাত আদায় করতেন। প্রচলিত নামাজের মত উঠ বস, বৈঠক, রুকু- সিজদার মাধ্যমে না কি ভিন্ন কিছু। আদম আঃ থেকে শুরু করে সকল নবী রাসুল গনই সালাত আদায় করতেন। তা সে সালাত কেমন ছিল? এমন কি আকাশের উড্ডিয়মান পক্ষীকুলও সালাত আদায় করে থাকে।
তুমি কি দেখ না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যাহারা আছে তাহারা এবং উড্ডীয়মান বিহঙ্গকুল আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই জানে তাহার ‘ইবাদতের ও পবিত্রতা ঘোষণার পদ্ধতি এবং উহারা যাহা করে সে বিষয়ে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। [ ২৪;৪১ ]
কোরান তেলোয়াত করা এক বিষয় এবং সালাত কায়েম আরেক বিষয়। নবীর উপর কোরানের আয়াত নাযিল হলে তা ভাল ভাবে ধীর স্থীরে বুঝে বুঝে তেলোয়াতের নির্দেশ হত। প্রত্যেকে যেন বুঝতে পারে আয়াতের মর্ম। কি তাতে বলা হয়েছে এবং সে মোতাবেক নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে পরিচালিত করতে পারে। এটি ছিল নবী- রাসুলের প্রতি প্রথম কর্তব্য যা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য।
অতপর যে মুখ্য দায়িত্ত ছিল তা হল সালাত কায়েম করা।
সালাত কায়েম করা মানে রবের সাথে সংযোগ সাধন করা, এবং তা সবার মাঝে প্রচার করা। সে জন্য নবী সকাল সন্ধায় নির্দিষ্ট অঞ্চলে গমন করে বিশ্বাসীদের মাঝে প্রচার করতেন যা রবের সাথে সংযোগ স্থাপন করে দিতেন। আল্লাহ বলেনঃ তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করে, ইহা তাহাদের জন্য এক উপদেশ। [১১:১১৪ ]
রব কি করতে বলেছেন কি নিষেধ করেছেন, কি ভাবে ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক জীবন পরিচালনা করে সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা যাবে এবং হেদায়ত প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় চিরস্থায়ী জীবন জান্নাতে ফিরে যাওয়া যাবে। সাহাবীদের নিয়ে এই যে রবের সাথে নিবীর সংযোগ স্থাপন বৈঠক এটিই ছিল নবী- রাসুলের সালাত কায়েম। এভাবেই কোরানের নাযিলকৃত আয়াত গুলি সবার নিকট প্রচার করে দেওয়ার জন্যই রবের নির্দেশ ছিল।
রবের সাথে বান্দার এই সংযোগ বৈঠকে অংশ গ্রহনের জন্য সকলকে পরিস্কার পরিচ্ছনতা অর্জন করতপ হত এবং মানসিক ভাবে ধৈর্য ও সকল জাগতিক মোহ,নেশা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে উপস্থিত হতে হত। যেন আয়াতে কি বলা হচ্ছে তা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তাই সালাতে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে একনিষ্ঠ ভাবে দন্ডায়মান হতে হত বা অংশ গ্রহন করতে হত। তাই তো সুরা নিসার ৪৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
হে মু’মিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হইও না, যতক্ষণ না তোমরা যাহা বল তাহা বুঝিতে পার, [ ৪:৪৩ ]
তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর সূরা নম্বর: ২ আয়াত নম্বর: ৪৫
আলোচনার শেষে স্পষ্ট প্রতীয়মান নবী রাসুলগন প্রচলিত রুকু,সিজদা সম্বলিত উঠ বস করার ফরমেটে কোন সালাত আদায় করেন নি। রবের সাথে নিবীর সংযোগ স্থাপনের জন্য কোরানের আদেশ নিষেধ অনুসরন করে বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ও সবার মাঝে কোরানের উপদেশ পৌছে দেওয়াই ছিল তাঁদের আকিমুস সালাত।
বর্তমান সালাতের ফরমেট বিকৃত এবং নবী রাসুলের সালাতের অনুরুপ নহে। এই বিকৃত ফরমেটের সালাত নিয়ে আল্লাহ বলেনঃ
উহাদের পরে আসিল অপদার্থ পরবর্তীরা, তাহারা সালাত নষ্ট করিল ও লালসা – পরবশ হইল। ১৯:৫৯
ইতিপুর্বে তাদের সালাত ছিল — কা‘বাগৃহের নিকট শুধু শিস ও করতালি দেওয়াই তাহাদের সালাত, সুতরাং কুফরীর জন্য তোমরা শাস্তি ভোগ কর।[৮:৩৫ ]