Categories
Blog

জোনাকির আলো জ্বলে

  1. সরদার বংশের ইতিহাস ও স্মৃতিচারণ

আমি এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল। জন্ম ৯ই মার্চ, ১৯৬০। আমি একাধারে ইতিহাস প্রেমী, স্মৃতিচারণকারী এবং আমার পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া একটি গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

আমার বংশের শিকড় গেঁথে আছে আরব দেশের ইয়েমেনে। সেই বংশের প্রবাহকে ধরে রাখতে আমি আমার পূর্বপুরুষদের লিপিবদ্ধ করছি।

মানুষ তার অতীতকে জানে বলেই ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পায়। আমরা, যারা আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তাদের প্রতিটি ধাপের পেছনে রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস, সংগ্রাম, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ। এই গ্রন্থ, ‘সরদার বংশ: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অমল ছায়া’, কেবল কিছু নাম-পরিচয়ের সংকলন নয়—এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস; যা রক্তের ধমনী বেয়ে ভেসে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

এই লিখায় তুলে ধরা হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই গল্প, যা হয়তো সব কাগজে লেখা ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের গহীনে বয়ে চলেছিল। ইয়েমেন থেকে আগত ভাসান সরদারের বীরত্বগাথা থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায় রচিত হয়েছে ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও ঐতিহ্যবোধ দিয়ে।

আজকের এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য শুধু ইতিহাস সংরক্ষণ নয়—বরং একটি আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার। এই ব্লগ হবে একটি দিকদর্শন, একটি আত্মমর্যাদার স্মারক, এবং বংশের প্রতিটি সদস্যের জন্য একটি আত্মশুদ্ধির আয়না।

ঐতিহাসিক ধারায়:

রুপা সরদার (১৭৮৩–১৮৫৮)


কেবরাতুল্লাহ সরদার (১৮২৮–১৯০৮)


হামিদুর রহমান (১৮৫৫–১৯৩৮)


সাইদুর রহমান (১৮৮৮–১৯৬৩)


মজিবুর রহমান (১৯১৮–১৯৯৩)


একরামুল হক রুবেল (১৯৬০–বর্তমান

ভাসান সর্দারের আগমন ও এক বংশগাঁথার সূচনা

সরদার বংশের পারিবারিক বৃক্ষ

ভাসান সরদার (১৭৯৫–১৮০৩)
│
├── রুপা সরদার (১৮২০–১৯০৪)
│   │
│   ├── কেবরাতুল্লাহ সরদার (১৮২৮–১৯০৮)
│   │   │
│   │   ├── হামিদুর রহমান বড় মিয়া (১৮৫৫–১৯৩৮)
│   │   │   │
│   │   │   ├── সাইদুর রহমান (১৮৮৮–১৯৬৩)
│   │   │   │   ├── মজিবুর রহমান (১৯১৮–১৯৯৩)
│   │   │   │   │   ├── একরামুল হক রুবেল (১৯৬০–বর্তমান)
│   │   │   │   └── ইনামুল হক জুয়েল মিয়া
│   └── হাফিজুর রহমান মিয়া
│       ├── হাবিবুর রহমান মিয়া
├── মোখলেছুর রহমান মিয়া
│   └── হানিফ মিয়া
├── আকবর মিয়া
└── আহম্মদ মিয়া
    ├── হেমায়েতুল্লাহ সরদার
    └── এনায়েতুল্লাহ সরদার
├── সোনা সরদার
├── ইরাদ সরদার
└── ভিকু সরদার

 

১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ। তপ্ত বালুকাময় আরব ভূমি থেকে উত্তাল জীবন-তরীতে ভেসে আসেন এক তরুণ সাহসী পুরুষ — ভাসান সর্দার। মাত্র ২৫ বছর বয়সে, জীবনসঙ্গিনী ও একমাত্র পুত্র রুপা সর্দার-কে নিয়ে পাড়ি জমান তৎকালীন ভারতবর্ষের এক শস্যশ্যামল ভূখণ্ডে —পশ্চিম বাংলার বীরভূম।

এ ছিল শুধু একটি অভিবাসন নয় — ছিল এক বংশের নতুন সূচনা, এক ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টানোর মুহূর্ত। বীরভূমের মাটিতে পা রাখার পর, ভাসান সর্দার আরো দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক হন।  তাঁর পুত্ররা হলেন —

ভাসান সরদার (স্ত্রী: ফারাহ ইয়ামেনা)
│
├── পুত্র: রুপা সরদার
├── পুত্র: সোনা সরদার
├
├── পুত্র: ভিকু সরদার
├── কন্যা: (নাম অজ্ঞাত)

কন্যার নাম কালের অতলে হারিয়ে গেলেও, তাঁর জীবনের প্রান্তর আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।জানা যায়, তিনি থেকে গিয়েছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদে, পশ্চিম বাংলার প্রাণ ভূমিতে।

তিন পুত্র পরে নিজ নিজ গৃহভূমি গড়ে তোলেন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে —

🔹 সোনা সর্দার বসতি স্থাপন করেন সারুলিয়া মিয়াবাড়ী, পরবর্তীতে যা হয়ে ওঠে দুরমুট মিয়াবাড়ী।

🔹 ভিকু সর্দার হয়ে ওঠেন কাজাইকাটা   মিয়া বাড়ীর প্রারম্ভিক পুরুষ – যাঁর উত্তর সূরিরা পরিচিত জামাল চাচা ও হীরু চাচা নামে।

আর রুপা সরদার রয়ে যায় পশ্চিম বাংলার      বীরভুমে। এই আলোচনার সীমারেখাঃ

এই গ্রন্থখণ্ডে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে শুধু ভাসান সর্দারের জ্যেষ্ঠ পুত্র রুপা সর্দার এবং তাঁর উত্তরসূরি কেবরাতুল্লাহ সরদার ও হামিদুর রহমান বড় মিয়াকে নিয়ে — যাদের কীর্তি, সংগ্রাম ও উত্তরাধিকার আমাদের প্রেরণা ও গৌরবের প্রতীক। পরবর্তি অধ্যায়ে অন্যান্যদের নিয়ে আলোচনা করা হবে। 

সোনা সরদার ও ভিকু সর্দার — এই দুই ভ্রাতার বংশধারা নিয়ে আলোচনা হবে পরবর্তী অধ্যায় সমূহে, ইনশাআল্লাহ।

এই ছিল এক ভিনদেশী যুবক ভাসান সরদারের স্বপ্নের অভিযাত্রা, যার বীজ বপন আজ এক মহীরুহ — সময়ের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার বুকে।

 

বংশধারার প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক পটভূমি ভাসান সরদার একাধারে ধর্মীয় প্রচারক ও বণিক ছিলেন। তিনি ইয়েমেন থেকে নিয়ে এসেছিলেন একটি রহস্যময় সোনার বাক্স, যার ওজন ছিল প্রায় সোয়া দুই কেজি এবং এতে ছিল চারটি পৃথক কুঠুরি, ধারণা করা হয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এ ধন তিনি পাথেয় হিসেবে পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর নাতি কেবরাতুল্লাহ সরদার এই সম্পদ ব্যবহার করে তালুক ও জোত ক্রয় করেন, যা সরদার বংশের জমিদারি প্রতিষ্ঠার সূচনা করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সরদার পদবি “সরদার” বা “সর্দার” ছিল এক সময়কার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাধি। এটি একসময় উসমানীয় সাম্রাজ্যে সামরিক পদবী এবং ইউরোপের কিছু অঞ্চলে অভিজাত পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে “সরদার”রা নেতৃত্ব দিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। নবাবী আমলে বাংলার প্রভাবশালী বংশগুলোর মধ্যে সরদার বংশ বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য।

ভাসান সর্দার: বালুকাবেলায় লিখা ইতিহাসের শিকড়।

আঠারো শতকের শেষ ভাগে, দূর আরব ভূমি ইয়েমেনের ধূলিধুসর প্রান্তর থেকে এক অজ্ঞাত যাত্রায় বের হলেন এক তরুণ। নাম তাঁর — ভাসান সর্দার। বয়স মাত্র ২৫। পিতার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি সঙ্গে পেলেন একটি রহস্যময় বাক্স — সোনার পাত বসানো কাঠের তৈরি, ভিতরে চারটি পৃথক কুঠুরি। তার মধ্যে ছিল মূল্যবান পাথর, মশলাদার সুগন্ধী এবং ধরা হয় — ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের উপাদান। ওজন প্রায় সোয়া দুই কেজি। কী উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা এই বাক্স দিয়েছিলেন — তা অজানা, তবে ধারণা করা হয়, নতুন ভূখণ্ডে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এই পাথেয়।

সেই অজানা দেশ ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষ। সময়টা ১৭৮০ দশক। নবাবদের পতনের পর পরগনার জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা। গড়ে ওঠে ইংরেজপন্থী জমিদার শ্রেণি। ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির গভীর পরিবর্তনের সময়েও ভাসান সর্দার একাই পথ চলেন — শুধু বিশ্বাস আর আশ্রয় হিসেবে সঙ্গে ছিল তাঁর স্ত্রী ফারাহ ইয়েমেনী।

মল্লিকা বনের নেপথ্য— এক নারী, এক যাত্রা যখন ফারাহ ইয়েমেনী ভারত বর্ষের মাটি ছুঁয়েছিলেন, তখনও তাঁর হৃদয়ে গুনগুন করছিল মাতৃ ভূমির বাতাস। কিন্তু সময়ের স্রোত তাঁকে আর ফেরার সুযোগ দেয়নি। তিনি থেকে যান অচেনা এক মাটিতে — স্থায়ী হয়ে ওঠেন ইতিহাসের এক অমূল্য চরিত্রে। তাঁর স্নেহ আর সাহচর্যে ভাসান সর্দার এগিয়ে যান, হয়ে ওঠেন মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ — বিশেষত অধিকার বঞ্চিত মুসলিম জনপদের মাঝে।

ইতিহাসের চাকা: জমিদারী, সংগ্রাম ও উত্তরাধিকার

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে সেই ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজের হাতে চলে যায়। মুসলিম শাসকগণের ছায়া ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে, এবং হিন্দু জমিদারগণ ব্রিটিশদের সহচর হয়ে উঠেন। এ সময় মুসলিম জমিদারদের অবস্থা হয় করুণ — হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই প্রান্তিক।

এই পটভূমিতে ভাসান সর্দার তাঁর ৮টি পরগনার জমিদারী নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। ধীরে ধীরে তিনি ও ফারাহ ইয়েমেনী তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক-জননী হন। কিন্তু সময় অপেক্ষা করে না। ১৮৪৮ সালে এই সংগ্রামী মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। বড় পুত্র রুপা সরদার দায়িত্তভার কাঁধে তুলে নেন।

রুপা সর্দার: উত্তরাধিকার ও বিবর্তনের পথে

বড় ছেলে রুপা সর্দার বাবার রেখে যাওয়া জমিদারী হাতে তুলে নেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ভিন্ন পথের পথিক। তিনি ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, হিন্দু জমিদারদের মতো সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেন নিজেকে। একে একে পরগনা, তালুক, জোত বৃদ্ধি করে এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যান — অনেকটা অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির মতই এক অদম্য আগ্রহ।

ভাইদের মধ্যে সোনা সর্দার ছিলেন রঙমহলের সখ্যতাপূর্ণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত — গান, সঙ্গীত আর আসরে ব্যস্ত। ভিকু সর্দার ছিলেন আত্মনিমগ্ন, দুনিয়া বিমুখ সাধকের মতো।  ভিকু সর্দার, কনিষ্ঠ হলেও রুপার ছায়াসঙ্গী — যেন প্রতিটি সিদ্ধান্তে নীরব সহচর।

রুপা সর্দারের উত্তরসূরি: নতুন প্রজন্মের গল্পঃ

এ অধ্যায়ে প্রথম রুপা সরদার ও তার উত্তর সুরিদের নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। পরবর্তিতে তার ভাই সোনা সরদার ও ভিকু সরদারদের নিয়ে পর্যায় ক্রমে আলোচনা করবো।

ইংরেজরাও রুপা সর্দারের বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ। সময়ের আবর্তে তিনি হয়ে ওঠেন তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক:

১) কেবরাতুল্লাহ সরদার।  

২) হেমায়েতুল্লাহ সরদার।  

৩) এনায়েতুল্লাহ সরদার। 

এবং আদরের একমাত্র কন্যা — রুপমা সর্দার

ভাসান সর্দার
│
└── রুপা সর্দার
    ├── কেবরাতুল্লাহ সর্দার
    ├── হেমায়েতুল্লাহ সর্দার
    ├── এনায়েতুল্লাহ সর্দার
    └── রুপমা

 

এই পরিবারই এক সময় ইতিহাসের সেই ধারা রচনা করে, যার সূত্র ধরে জন্ম নেয় পরবর্তী প্রজন্ম — নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সম্ভাবনা আর সংগ্রামের পথ বেয়ে এগিয়ে চলে সরদার বংশের গৌরব গাথা।

এই গল্প কেবল একটি বংশের নয়। এটি এক গুচ্ছ আত্মত্যাগ, স্বপ্ন আর ইতিহাসের পদচিহ্ন। ভাসান সর্দার ও তাঁর উত্তরসূরিরা ছিলেন সময়ের সাক্ষী — যারা ইতিহাসের প্রান্তে নয়, মাঝখানেই নিজেদের নাম অঙ্কন করেছেন।

ভাগ্য চক্রে বাঁধা ইতিহাসের পালাঃ

(পর্ব– ২: উত্তরাধিকার, প্রেম ও প্রাসাদ ভবনের প্রাচীরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস)

রুপমা — রুপা সরদার পরিবারে পিতার আদরের একমাত্র কন্যা। জমিদার রুপা সর্দারের চোখের মণি রুপমা। সেই কন্যাই একদিন নবাব পরিবারের উত্তরসূরির ঘরণী হয়ে চলে যান মুর্শিদাবাদে।

একদিকে পরিবারের বুকে শূন্যতার বিষাদ, অন্যদিকে নতুন ঘরের সাজানো স্বপ্ন। চিরচেনা উঠোন, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ আর ভাইদের হাত ধরে খেলা— সব কিছু ছুঁয়ে যায় রুপমার চোখের কোণ। কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। সে কাউকে থেমে থাকতে দেয় না।

নতুন গৃহে প্রবেশের সাথে সাথেই রুপমা বুঝে গেলেন— জীবন যেন শুধু আনন্দের নয়, তা এক গভীর দায় ও দায়িত্বের সূত্রে বাঁধা।

এই বিয়ের সূত্রেই রুপা সর্দার মুর্শিদাবাদে এক নতুন ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করেন। জমিদার বাহাদুর শ্রীযুক্ত অবনি রায়ের জমিদারী তিনি নিজের কৌশলে দ্বিগুণ খাজনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিনিয়ে নেন। তখন সময় ১৮৪৬ সাল— জমিদারী প্রথা ইংরেজ শাসকদের মদদে তুঙ্গে। সেদিনের মেদেনীপুর ছিল রঙের আবিরে মোড়ানো, সংগীতের গুঞ্জনে বিভোর। সে সময়ে পশ্চিম বাংলার ধামাইল গীত গান ছিল।

 

কন্যার বিয়ের পর পরই পুত্র কেবরাতুল্লাহ সরদারের বিয়ের আয়োজন করেন পশ্চিম নদীয়া ৫ পরগনার জোতদারে একমাত্র কন্যা আম্বর নেসার সাথে।  কিন্তু পুত্র ভালবাসতেন  দরিদ্র এক হিন্দু প্রজার মেয়ে চন্দ্রা বলীকে যা পিতা জানতেন না । সামাজিক প্রতিবন্ধকতা যাহাই হোক ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা পাহাড় সম বাঁধ সেজে বসেছিল বলে তিনি পরিবারের কাছে প্রকাশ করতে পারেন নি কখনো।

পরিবারে উৎসবের আমেজ, আত্মীয়-স্বজনের কোলাহল, বিয়ের প্রস্তুতির রঙিন স্বপ্ন—সব কিছু যেন নিখুঁত ভাবেই এগোচ্ছিল।

কিন্তু,এই উজ্জ্বল আয়োজনের আড়ালে, নীরবে বয়ে যাচ্ছিল এক ভিন্ন স্রোত।

কেবরাতুল্লাহর হৃদয়ে ছিল অন্য এক নাম—চন্দ্রা বলী। দরিদ্র এক হিন্দু প্রজার কন্যা, যার সরল হাসি ও চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোমল অনুভূতি তাঁর প্রাণে গেঁথে গিয়েছিল বহু আগেই।

তবে ভালোবাসা কখনো কখনো সমাজের দেয়ালে ঠেকে যায়। সেই দেয়াল ছিল এখানে অটল—ধর্মের পার্থক্য, বর্ণের বিভেদ, আর সমাজের কঠিন বিধি। ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা যেন পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের মাঝে। কেবরাতুল্লাহ জানতেন — এই সত্য উচ্চারণ মানেই পরিবারের বুকে ঝড় তোলা, সম্মানের দেয়ালে ফাটল ধরানো। তাই তিনি চুপ করে ছিলেন।

ভালোবাসাকে বুকে লুকিয়ে, সমাজের নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করেই এগিয়ে গেলেন জীবনের পথে।

প্রথম দিকে সবই ছিল নিখুঁত। সুরেলা বাংলা গানের আবহে জমে উঠেছিল নব দাম্পত্য জীবন। এক পুত্রের পিতা হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু এই সাজানো সংসারে হঠাৎই ঢুকে পড়ে এক অনাহূত মোড়।

চন্দ্রাবলীর অন্তর্দ্বন্দ্বঃ

কেবরাতুল্লাহর প্রতি তার আকর্ষণ  কেবল রূপে ছিল না, বরং সেই স্নিগ্ধ মানবিকতায় যা ধর্ম, জাতি, প্রথার গণ্ডি পেরিয়ে হৃদয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু রক্ষনশীল সমাজের প্রাচীন নিয়ম, ধর্মীয় গোঁড়ামি, আর সমাজের শীতল দৃষ্টি যেন তার পথের চারপাশে কাঁটার বেড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিদিনের মতো মা যখন তার জন্য মন্দিরে প্রদীপ জ্বালায়, তখন চন্দ্রাবলীর মনে পড়ে যায় কেবরাতুল্লাহর আজানের সুর—দুটি জগতের আহ্বান, যা তাকে টেনে নিয়ে যায় এক অদৃশ্য প্রান্ত সীমায়।

এ ছিল না শুধু এক কিশোরীর প্রেম কাহিনি; এটি ছিল তার আত্মার যুদ্ধ—ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার তীব্র টানাপোড়েন। সেই অন্তর্দ্বন্দ্বের আগুনে চন্দ্রাবলীর হৃদয় ধীরে ধীরে গলতে থাকে, আর তার নীরব চোখের জল হয়ে ওঠে সেই অদৃশ্য সেতু, যা প্রেম ও প্রথার মাঝে ঝুলে থাকে, অনিশ্চিত পরিণতির অপেক্ষায়। হৃদয় কোনে ধ্বনিত হয় গানের সুর

প্রেম যেন মোর গোধুলী বেলার পান্থ পাখি —

চন্দ্রাবলী যেখানে জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক একই রাতে কেবরাতুল্লাহ নিজের ঘরের অন্ধকারে বসে দেয়ালে দৃষ্টিহীন চোখ রাখে।

তার মনে একদিকে বাবা-মায়ের স্বপ্ন, অন্যদিকে চন্দ্রাবলীর হাসি—দুটো যেন একই দড়ির দুই প্রান্ত, যা তাকে মাঝখানে ছিঁড়ে ফেলতে চায়।

রাতের গভীর নীরবতায়, চন্দ্রাবলী জানালার পাশে বসে আকাশের অশেষ নীলতরঙ্গের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকে। তার চোখে যেন অসীমের একান্ত কান্না বাজে, মনের এক গভীর দ্বন্দ্বের ছায়া ছড়ায় তার নরম হাসির ভেতর। আকাশের নক্ষত্রগুলো তার অজান্তে যেন তার দুঃখের মর্মর স্পর্শ করছে, কিন্তু তার হৃদয়ের ভেতর কোথাও যেন এক কালো মেঘ জমে আছে — ভাঙার আগের সেই অস্থিরতা, যা তাকে অজানা পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক একই রাতে, ঘরের অন্ধকারে, কেবরাতুল্লাহ বসে দেয়ালের দিকে নিঃশব্দ, দৃষ্টিহীন চোখে। তার মন বারবার ছিন্ন হয়ে পড়ছে; এক প্রান্তে বেঁচে আছে বাবা-মায়ের অবাধ্য স্বপ্নের বেজানু কথা, অন্য প্রান্তে ঝলমল করে চন্দ্রাবলীর মায়াময় হাসি। এই দুই তারার মাঝে সে যেন একাকী ভাসমান, যেন এক অদৃশ্য দড়ির উপর হাঁটছে — যার একধার থেকে ছিঁড়ে পড়ার আতঙ্ক তাকে ভেঙে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

দুই হৃদয়ের এই সমান্তরাল যন্ত্রণায়, চন্দ্রাবলীর নিঃশ্বাস আর কেবরাতুল্লাহর অচেতন চেতনায় বয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত, গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বের স্রোত। 

চন্দ্রাবলীর মতো সেও জানে, এই প্রেমের পথ কেবল ফুলে ভরা নয়—এখানে আছে কাঁটা, আছে গুজব, আছে অদৃশ্য দেয়াল। কিন্তু হৃদয়ের ভেতরের মমতা কি কোনো দেয়াল মানে?

যখনই সে চন্দ্রাবলীকে দেখে—পোড়ামাটির উঠোনে, চুলে সূর্যের আলো খেলা করছে—তখন তার মনে হয়, এই মুহূর্তের জন্যই যেন সে জন্মেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় গ্রামের ইমামের কথা, বাবার কঠোর দৃষ্টি, আর সমাজের শীতল আইন।

চন্দ্রাবলীর চোখে যেন অনন্ত আকাশের নীল, অথচ সেই নীলের তলায় জমে আছে অনন্ত দ্বন্দ্বের কালো মেঘ। সে সমাজের সকলে জানে—সে শুধু সুন্দরী নয়, সে যেন ভোরের প্রথম পদ্মফুল, যার পাপড়িতে শিশির ঝলমল করে। কিন্তু আজ সেই হাসি শুকিয়ে গেছে; হৃদয়ের ভেতর কোথাও অদৃশ্য বেদনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

জমিদার পুত্র কেবরাতুল্লাহর প্রতি প্রজা-কন্যার দৃষ্টি—এ যেন সমাজের চোখে অবাধ্যতা, আর পিতার চোখে অপমান। তাই পিতা শপথ নেন—“মেয়ে আমার, ওই পথে আর এক পা-ও দেবে না।”

পিতার শপথ যেন চন্দ্রাবলীর বুকের উপর পাথর হয়ে চাপল। সে চেষ্টা করল—হ্যাঁ, চেষ্টা করল কেবরাতুল্লাহকে এড়িয়ে যেতে, তার দৃষ্টির উষ্ণতা ভুলে যেতে। কিন্তু হৃদয় কি শপথ মানে?

কেবরাতুল্লাহ অবশেষে হতাশ হয়ে গেল। চন্দ্রাবলী দূরে সরে গেলে সেও দূরে দাঁড়াল, পেছন ফিরে আর ডাক দিল না।

দিনের পর দিন এই নীরব যুদ্ধ চলল, যতদিন না কন্যার মুখের আলো নিভে যেতে শুরু করল। খাওয়া নেই, ঘুম নেই—মেয়েকে ধীরে ধীরে মলিন হতে দেখে পিতা একদিন ভেঙে পড়লেন। কেঁদে বললেন— “যা মেয়ে, তুই যদি বাঁচতে চাস, তবে শপথ ভাঙলাম।”

চন্দ্রাবলীর বুকের মধ্যে হঠাৎ বসন্ত নেমে এল—সে আবার কেবরাতুল্লাহর প্রেমে ডুব দিল। কিন্তু ততক্ষণে সময় এগিয়ে গেছে্ অনেক দূর। কেবরাতুল্লাহ ততক্ষনে পশ্চিম নদীয়ার এক ধনী জোতদারের একমাত্র কন্যার স্বামী, গৃহস্থ জীবনে বদ্ধ।

সেই খবর চন্দ্রাবলীর হৃদয়কে যেন ছিঁড়ে ফেলল।অন্ধকার রাতের এক কোণে, অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে সে গান ধরল—

“ও তুমি যে রূপ লইয়া বড়াই কর রে বেইমান, জানি সেই রূপ হয়ত আমার নাই…”

প্রেমের স্বপ্ন ভেঙে, ব্যর্থতার গ্লানি ও বুকভরা কষ্ট নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল—এই জীবন আর টানার নয়। আত্ম হত্যাই মুক্তি।

কেবরাতুল্লাহ পুনরায়  চন্দ্রাবলীর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে পরে। প্রেম পরকীয়ার মধ্য দিয়ে গোপনে চন্দ্রাবলীর সাথে প্রনয়ের মালা পড়ে নেয়।

তবে তিনটি শর্ত দেয়:-

১) সে আর তার পরিবারে কোন দিন ফিরে যেতে পারবে না।

২) আজ থেকে তার নাম চন্দ্রাবলী পরিবর্তন করে পয়ার নেসা।

৩) পরিবার মেনে না নেয়া পর্যন্ত মুল বাড়ীতে নয় বরং বাগীচা বাড়ীর পুরান প্রসাদে গোপন থাকতে হবে।

চন্দাবলী সব শর্ত মেনে নিয়ে জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। আনন্দঘন সে পরিবেশে মনের গহীনে গানের সুর তাল মিলা।

আসিবে কি সে লগন মোর জীবনে —

সব বাধ ভেঙে বিয়ে: দিনের পর দিন লুকিয়ে দেখা, গোপন বার্তা আদানপ্রদান, আর নীরবে অশ্রু ফেলার পর একদিন কেবরাতুল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন—তিনি আর ভয়ের কাছে হার মানবেন না।

প্রথম স্ত্রী আম্বর নেসাকে ঘরে রেখেই, এক রোখা জমিদার পুত্র সব বাধ ভেঙে চন্দ্রাবলীকে বিয়ে করেন। গোপনে তাকে বাগান বাড়ীর পুরাতন প্রাসাদে  রাখা হয়, আর নতুন নাম দেওয়া হয়—পয়র নেসা। মধুময় দিন ক্ষনে গানের সুর ভাসে —

এ ভাবেই একদিন প্রেমের পূর্ণতা আসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান আকবরের জন্মের মাধ্যমে।

যখন খবরটি প্রথম স্ত্রী আম্বর নেসা ও পরিবারের কানে পৌঁছায়, তখন প্রথমে ক্ষোভ, পরে ধীরে ধীরে বংশের উত্তরসূরির মায়ায় পয়র নেসাকে বাগিচা বাড়ির প্রাসাদ থেকে নিজ আঙিনায় আনা হয়।

যদিও বংশের স্বার্থে পয়র নেসাকে মেনে নেওয়া হয়, কিন্তু কেবরাতুল্লাহর ঘন ঘন পয়র নেসার গৃহে যাতায়াত আম্বর নেসার মনে কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে। প্রায়ই শুরু হয় মন কষাকষি, ঠান্ডা যুদ্ধ।

একদিন রাতের নীরবতায়, অন্তর্গত কষ্ট লুকাতে না পেরে আম্বর নেসার ঠোঁট থেকে ভেসে ওঠে এক বেদনার গান—

“জাওগি হরি বংশিধারী, উঠো না মোর বাসরে…সারা রাত্রি কাটাইলে, চন্দ্রাবতীর কুঞ্জেতে…”

প্রথম জীবন ছিল নির্মল নদীর স্রোতের মতো। সুরেলা বাংলা গানের আবহে নবদাম্পত্য জীবন কেটেছিল সোনালি রোদের মতো উজ্জ্বল দিনে। সন্তানের জন্মে সংসারে আনন্দের ঢেউ লেগেছিল।

দুই ঘর, দুই নারী, আর এক পুরুষ—জীবনের নদী তখন ঠিক দুই ধারায় বইছে। এক ধারে জমিদারির বিস্তারের লড়াই, অন্য ধারে হৃদয়ের টানাপোড়েন।

এভাবেই সময়ের সাথে পথ চলায় বাবা রুপা সর্দারের মৃত্যু যেন কেবরাতুল্লাহর জীবনে এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে আনল।

পশ্চিম বাংলার অবসান, পূর্ব বাংলার শুরু

১৮৫৫ সালে পিতা রুপা সর্দারের মৃত্যু হলে কেবরাতুল্লাহ জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর একরোখা মনোভাব ও আবেগঘন সিদ্ধান্তের কারণে ধীরে ধীরে জমিদারী সংকুচিত হতে থাকে।

১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলে তিনি মেদেনীপুর ছেড়ে পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরের মনস্থ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব বাংলা বিষয়ক রচনা তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল।

বাবার প্রস্থানের পর পশ্চিম বাংলার ঘরবসতি হঠাৎই যেন শূন্য হয়ে গেল। জমিদারির কাগজপত্র, প্রজাদের হিসাব, দু’টি সংসারের ভেতর-বাহির—সব মিলিয়ে কেবরাতুল্লাহর মন হাহাকার করে উঠল। পুর্ব বাংলায় থাকা চাচাদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার বাসনা তার বুকের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে বসে।

আম্বর নেসার ঘরে জন্ম নিল হামিদুর রহমান, আহম্মদ মিয়া ও দুই কন্যা; চন্দ্রাবলীর ঘরে জন্ম নিল একমাত্র পুত্র আকবর মিয়া। সবই যেন সুখের ছবি—যতক্ষণ না ভাগ্যের কঠিন আঁচড়ে ছবির রঙ ম্লান হতে শুরু করল।

পুর্ব বাংলায় থাকা চাচা ভিকু সর্দার, সোনা সর্দারের সান্নিধ্যে যাওয়ার বাসনা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একরোখা স্বভাব ও জেদের কারণে তার জোতদারি ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে।

১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলে, তার মন পুরোপুরি স্থির হয়—পশ্চিম বাংলাকে বিদায় দিয়ে পূর্ব বাংলায় নতুন করে বসতি গড়ার। রবীন্দ্রনাথের পুর্ব বাংলা-প্রাণবন্ত গল্প গুচ্ছ যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়—তার মন আরও ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

বোন রুপমাকে মুরশিদাবাদে রেখে, তিনি যাত্রা করেন পূর্ব বাংলার পথে। ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী মোমেনশাহী জেলার জামালপুর মহকুমার মেলান্দহের কাজাইকাটা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বড় চাচা সোনা সর্দার ইতিমধ্যেই সারুলিয়ায় বসতি গড়েছিলেন। ভারতের বীরভূম থেকে আগমনের সময়, পিতার ইয়েমেন থেকে আনা সোনার বাক্সের আট আনা অংশ নিজের প্রাপ্য হিসেবে নিয়ে আসেন কেবরাতুল্লাহ। বোনের দুই আনা অংশ ফেরত দেন উদার মনের ভগ্নিপতি—ফলে কেবরাতুল্লাহ পান দশ আনা অংশ, যা তার নতুন জীবনের মূলধন হয়ে ওঠে।

আম্বর নেসার গর্ভে জন্ম নেওয়া দুই পুত্র ও এক কন্যা, আর চন্দ্রাবলীর গর্ভে জন্ম নেওয়া আকবর হোসেন—যিনি এতই সুফি ও পরহেজগার ছিলেন যে, সমগ্র বংশে তাঁর মতো ধর্মপ্রাণ আর কেউ দেখা যায়নি। জমিদারির প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না তাঁর। মৃত্যুর আগের দিন নিজেই গোসল সেরে নিজের কক্ষে বিশ্রামে যান, এবং খাজানচিকে কঠোরভাবে বলে দেন—তাকে যেন আর কেউ না ডাকে।

কেবরাতুল্লাহর জীবনের পথ এভাবেই বাঁক নিতে থাকে। বিয়ের কয়েক বছর পর তিনি পূর্ব বাংলার জাহাঙ্গীরনগর বিহারে যান এবং সিংহজানী মহকুমার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার শ্যামপুরে নতুন করে বসতি গড়েন। ১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলে ইতিহাস নতুন মোড় নেয়।

এইভাবেই কেবরাতুল্লাহ সর্দারের জীবন কেবল জমিদারি ইতিহাস নয়—এ যেন বেদনা, সংকল্প আর নতুন শেকড় গড়ার এক দীর্ঘ কাব্য।

ধর্ম বৈষ্যমের প্রেমের কারনে কিশোরী চন্দাবলী জীবনের শেষ অব্দি জমিদার প্রাসাদে বন্দী জীবনের মত কাটিয়ে আর কখনো পিতৃালয়ে যেতে পারেনি বলে গ্রামের চঞ্চল মেয়েটি বিধাতার নিকট গানের সুরে নিবেদন করে প্রায়শ:ই গাইত — হারানো হিয় নিকুঞ্জ পথে–

পরিবারের ট্রি চার্ট

ভাসান সর্দার — স্ত্রী: ফারাহ ইয়ামেনী
├── রুপা সর্দার — স্ত্রী: আম্বর নেসা
│   ├── কেবরাতুল্যা সরদার — স্ত্রী: আম্বর নেসা (২) ও চন্দ্রাবলী পয়ার নেসা
│   │   ├── হামিদুর রহমান বড় মিয়া — স্ত্রী: কুলসুম বেগম
│   │   │   ├── সাইদুর রহমান মিয়া
│   │   │   │   ├── মজিবুর রহমান মিয়া — স্ত্রী: এফতেদা বেগম রুবী
│   │   │   │   │   ├── এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল
│   │   │   │   │   ├── এ,কে,এম ইনামুল হক জুয়েল
│   │   │   │   │   ├── আফরোজা রহমান হেলেন
│   │   │   │   │   ├── মাহবুব রহমান বেলুন
│   │   │   │   │   ├── মাহমুদা রহমান হাসি
│   │   │   │   │   ├── মাকসুদা রহমান খুশি
│   │   │   │   │   ├── মাহফুজার রহমান লিপি
│   │   │   │   │   └── মুনছুরা রহমান ডলি
│   │   │   ├── হানিফ মিয়া
│   │   │   ├── আবদুর মা (কন্যা)
│   │   │   └── ছালেমন (কন্যা)
│   │   ├── আকবর মিয়া
│   │   ├── আহাম্মদ মিয়া
│   │   ├── অজানা (কন্যা)
│   │   └── রাশির মা (কন্যা)
│   ├── হেমায়েতুল্লাহ সরদার
│   ├── এনায়েতুল্লাহ সরদার
│   └── রুপা সরদার (কন্যা)
├── সোনা সরদার
├── ইরশাদ সরার
└── ভিকু সরদার

 

পশ্চিম বাংলা থেকে পুর্ব বাংলায় বিস্তারঃ

ঐতিহাসিক পটভূমি, ১৮৭২ সাল। প্রথম পদচারণা—ব্রহ্মপুত্রের তীরেঃ  পশ্চিম বাংলার প্রান্ত ছেড়ে, ১৮৭২ সালে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মানুষ কেবরাতুল্লাহ সর্দার নৌকায় ভেসে এলেন পূর্ব বাংলার মোমেনশাহী জেলার জামালপুর মহকুমার অন্তর্গত শ্যামপুর কাজাইকাটা গ্রামে। ব্রহ্মপুত্রের ধূসর ঢেউ, ভোরের কুয়াশা আর নদীর বুক চিরে আসা এক অপরিচিত তরী—এইভাবেই শুরু হয় সরদার বংশে আখন্দ বংশের স্থায়ী বসতির গল্প।

জমিদারির সূচনাঃ

সে সময় কালীপুর ছোট তরফ (পশ্চিম হিস্যা)-এর জমিদার ছিলেন শ্রীযুক্ত ঋতেন্দ্র কান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, বিএ, ও শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্র কান্ত লাহিড়ী চৌধুরী। তাঁদের কাছ থেকে কেবরাতুল্লাহ সর্দার খাজনার দাখিলা ও বিবিধ তলব—পথকর, শিক্ষাকর, শস্যকর, বিবিধ কর বাবদ মোট ৩৮৯ টাকা বাৎসরিক দশ আনা হিস্যা ধার্যে গ্রহণ করেন।

তিনি একসঙ্গে ক্রয় করেন— ৪টি তালুক ৮টি জোত ২টি গোদারা ২টি জলমহল। 

প্রতিটি জোতের আয়তন ছিল প্রায় ৫০০ বিঘা। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—গোয়ালীনির চর, বাঘলদী, গোবিন্দী, চরগোবিন্দী, হরিনধরা ও পাতিলাদহ। প্রজাদের সঙ্গে তিনি সরল শর্তে ইজারা চুক্তি করেন—যাতে তাঁদের জীবিকা বজায় থাকে, আবার জমির উৎপাদনও উন্নত হয়।

গড়ে ওঠা এক ক্ষুদ্র সমাজ

সময়ের পরিক্রমায় তাঁর জমিদারির জমিতে গড়ে ওঠে নানা পেশা ভিত্তিক পাড়া—পালপাড়া, সুতারপাড়া, কামারপাড়া, কুমারপাড়া, ঝালপাড়া, মাঝিপাড়া, গোয়ালপাড়া, তাতীপাড়া, কাঁসারুপাড়া, বেহারাপাড়া, মুদিপাড়া—এমনকি নিম্নশ্রেণীর খাজাঞ্চি ও শুভ্রদের জন্যও আলাদা বসতি।

নিম্নশ্রেণীর অসহায় প্রজাদের জন্য তিনি প্রতি পরিবারে ৩ বিঘা করে জমি বিনা মূল্যে দেন। জলমহল ও ছিটমহলগুলো সম্পূর্ণ করমুক্ত ঘোষণা করেন। প্রতিটি পরগনায় স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষাকরও বাতিল করেন।

এই উদারতার ফলেই চাচা সোনা সর্দারের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয়। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দেয়। শেষমেশ সমঝোতার অংশ হিসেবে কেবরাতুল্লাহ সর্দার পাতিলাদহ পরগনার দুটি জলমহল ও ২২ বিঘার একটি ছিটমহল সোনা সর্দারের নামে হস্তান্তর করেন—নাম মাত্র ইজারা চুক্তিতে।

তাঁর নিজ বাড়ির প্রাঙ্গণে ছিল একটি মসজিদ, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মক্তব, খাজনা আদায়ের কাচারী, জমির নথিপত্র সংরক্ষণের তহসীল অফিস, হাতিখানা, খাজাঞ্চিখানা, ঢোলের ডংকা, মালখানা, এবং বেহারাদের ও লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য করমুক্ত কলোনি।

সে সময়ের বড় মিয়া—হামিদুর রহমান—ছিলেন যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। যৌবনের পূর্ণতায় উজ্জ্বল, সুঠাম দেহে সুদর্শন রূপ, আর চোখে ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। বাবার জমিদারির ভার যেন তারই কাঁধে ছিল, তাই পরগনা থেকে পরগনায় ছুটে বেড়াতেন অক্লান্ত ভঙ্গিতে। প্রজারা তাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় নত হতো, আর স্নেহভরে ডাকত—বড় মিয়া। সেই সময় “মিয়া” সম্বোধন ছিল সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক, আর সেখান থেকেই সর্দার পদবি ধীরে ধীরে “মিয়া” পদবীতে রূপ নেয়।

গোয়ালদের জন্য বরাদ্দ পরগনাটির ইতিহাসেও তার অবদান অমলিন। গোয়ালপাড়ার প্রজাদের দারিদ্র্য ও অসহায় জীবন দেখে তিনি এক মুহূর্তও দ্বিধা করেননি—বাবার অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘোষণা করলেন, সবার ইজারা জমির খাজনা মাফ। শুধু তাই নয়, জলমহলের পারাপারের জন্য গুদারা ঘাটের ইজারাও চিরতরে মুক্ত করে দিলেন।

তার এই সাহসী সিদ্ধান্ত যেন নতুন এক ভোর এনে দিল গোয়ালিনী চর ও গোবিন্দী চরের মানুষের জীবনে। দুই চরের মধ্যে নদীপথে বাণিজ্য হলো সহজ, প্রজাদের জীবনে এলো আর্থিক স্বস্তি ও সমৃদ্ধি। বড় মিয়ার নাম তখন শুধু প্রজাদের ঠোঁটেই নয়, তাদের হৃদয়ের গভীরে খোদাই হয়ে রইল—এক অভিভাবক, এক ন্যায়পরায়ণ নেতা, এক অমলিন স্মৃতি হয়ে।

বড় মিয়া—প্রজাদের বন্ধুঃ (হামিদুর রহমান)

বড় ছেলে হামিদুর রহমান, যাঁকে সবাই ভক্তিভরে ডাকতেন বড় মিয়া। সুঠাম দেহ, সুদর্শন মুখমণ্ডল, আর বুকে প্রজাদের জন্য অগাধ মমতা—এই ছিল তাঁর পরিচয়। সেই সময় “মিয়া” সম্বোধন ছিল সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক। তাঁর অবদানেই সর্দার পদবী ধীরে ধীরে রূপ নেয় মিয়া পদবীতে।

গোয়ালীনির চর পরগনার প্রজাদের দারিদ্র্য দেখে তিনি বাবার অনুমতি ছাড়াই তাঁদের ইজারা জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ ঘোষণা করেন। এমনকি জলমহলের পারাপারের গোদারা ঘাটের ইজারাও তিনি প্রজাদের জন্য মুক্ত করে দেন। ফলে গোয়ালীনির চর ও গোবিন্দীর চরের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পথ উন্মোচিত হয়।

চাচা-ভাতিজার বিরোধ: 

এই উদার নীতির কারণে চাচা সোনা সর্দারের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়। সমঝোতার অংশ হিসেবে কেবরাতুল্লাহ সর্দার পাতিলাদহ পরগনার দুটি জলমহল ও ২২ বিঘার একটি ছিটমহল চাচার কাছে নামমাত্র ইজারায় হস্তান্তর করেন।

সরদার বাড়ির প্রাঙ্গণ নিজ বাড়িতে তিনি গড়ে তোলেন— একটি মসজিদ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি মক্তব খাজনা আদায়ের কাচারী তহসীল অফিস হাতিখানা খাজাঞ্চিখানা মালখানা লাঠিয়াল বাহিনী ও বেহারাদের জন্য করমুক্ত কলোনি

বড় মিয়া — এক সময়ের প্রতিচ্ছবি

একদিন গোয়ালপাড়ায় এসে দেখলেন, ইজারার ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে প্রজারা। ক্ষীণদেহ কৃষকরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, তাদের চোখে অব্যক্ত অনুরোধ।

“বড় মিয়া, খাজনার টাকা দিতে পারছি না… বউ-বাচ্চা নিয়ে অনাহারে আছি।”কথাটা বলতেই বৃদ্ধ গোপাল কাকুর চোখ ভিজে উঠল।

হামিদুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর ঘোড়া থেকে নেমে বললেন, “শুনুন সবাই! আজ থেকে আপনাদের ইজারার খাজনা মাফ। এই মাটিতে যারা ঘাম ঝরাবে, তারা খাজনার বোঝা বইবে না।”

প্রজাদের মধ্যে এক মুহূর্ত নীরবতা, তারপর যেন আনন্দের বিস্ফোরণ। কেউ কেঁদে ফেলল, কেউ হাত উঁচিয়ে দোয়া করল— “আল্লাহ আপনাকে হায়াত দিক, বড় মিয়া!”

কিন্তু এখানেই থামেননি তিনি। নদীর ঘাটে গিয়ে ঘোষণা দিলেন, — “গুদারা ঘাটের পারাপারের ইজারাও আজ থেকে চিরতরে মুক্ত। নদী সবার, পথ সবার—এখানে আর কারও বাধা থাকবে না।”

এরপর থেকেই গোয়ালিনী চর আর গোবিন্দী চর যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। নৌকা ভরা পাট, ধান, কলা—সবই অবাধে আসা-যাওয়া শুরু হলো। ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠল, প্রজাদের জীবনে এলো স্বস্তি।

বড় মিয়ার নাম তখন শুধু প্রজাদের ঠোঁটে নয়, তাদের রক্তের স্রোতেও বইতে লাগল— একজন নেতা নয়, বরং একজন অভিভাবক হিসেবে, যার দৃষ্টি সবসময় মানুষের কল্যাণে নিবদ্ধ।

এখান থেকেই সরদার পদবীটা পরিবর্তন হয়ে মিয়া পদবীতে ঠাই করে নেয়।

তবে এর আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গোপন রহস্য—যা পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ধরা পড়বে…

(পরের অধ্যায়ে সেই রহস্য উন্মোচিত হবে)

মাধবী পালের একতরফা  ভালবাসার যে শুধু দৃষ্টির কাছাকাছি ঠাই চেয়েছিল কিন্তু প্রকাশ করতে পারে নি কখনো সামাজিক মর্যাদার ব্যবধানে।

পরিবারের উত্তরাধিকার।  তাঁর তিন পুত্র—

১) হামিদুর রহমান (বড় মিয়া)

২) আকবর মিয়া

৩) আহাম্মদ মিয়া

দুই কন্যা— ছালেমন ও আবুর মা (যাঁদের একজনের বিয়ে হয় কুলকান্দী মুন্সী বাড়ি ও  অপরজনের দেওয়াংঞ্জের চিকাজানি মৌলভী আবুল হোসেনের কাছে)

পারিবারিক ট্রী চার্ট নিচে দেয়া হলঃ

ভাসান সরদার (১৭৬২–১৮৪৮) ── স্ত্রী: ফারাহ ইয়ামেনী
│
├── রুপা সরদার (১৭৮৩–১৮৫৬) ── স্ত্রী: আম্বর নেসা
│   │
│   ├── কেবরাতুল্লাহ সরদার
│   │   ├─ স্ত্রী ১: আতর নেসা
│   │   └─ স্ত্রী ২: চন্দ্রাবলী
│   │       └─ পুত্র: হামিদুর রহমান
│   │
│   ├── হেমায়েতুল্লাহ সরদার
│   └── এনায়েতুল্লাহ সরদার
│
├── সোনা সরদার
├── ইরশাদ সরদার
└── ভিকু সরদার

 

সরদার বংশে সরকার বংশের অনুপ্রবেশ

বসন্ত তখন বিদায়ের শেষ প্রহরে, বৈশাখের প্রথম দিনের আগমনী হাওয়ায় ধানপাকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। এমন সময় কেবরাতুল্লাহ সরদারের ঘোষণায় সরদারবাড়ি কেঁপে উঠল—পুত্র হামিদুর রহমান, অর্থাৎ সবার প্রিয় বড় মিয়া, বিয়ে করতে চলেছেন।

খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। প্রজাদের মধ্যে আনন্দের আবীর উড়ল, তবে সেই রঙে কোথাও কোথাও মিশে ছিল অদৃশ্য বিষাদের ছায়া—বিশেষত পালপাড়ার এক কিশোরীর অন্তরে।

প্রতি বছর বৈশাখের শুরুতে, খাজনা আদায়ের কাজ শেষ হলে, সরদারবাড়িতে চলত তিন দিনব্যাপী উৎসব। উঠোনে প্রজাদের জন্য ঘেঁটু গানের আসর, রঙমহলে নারীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আর জমিদার-পুত্র ও সঙ্গীদের জন্য ছিল বিশেষ জলসা ঘর—যেখানে খাস শিল্পীরা রাতভর গান শোনাতেন পূর্ণিমার নিশীথে।

সেই জলসা ঘরের প্রধান শিল্পী ছিলেন পাগলপাড়ার অবিনাশ পালের মেয়ে, মাধবী পাল। তার কণ্ঠস্বর ছিল যেন নদীর ঢেউয়ের মতো—কখনো নরম, কখনো তীব্র, কিন্তু সবসময়ই হৃদয় ভেদ করা মাধুর্যে ভরা। সুরে সুরে তিনি জয় করেছিলেন অতিথিদের মন, আর বিনিময়ে পেয়েছিলেন সোনা-রুপার অলংকার, স্মৃতিফলক, প্রশংসা। কিন্তু তার চোখের দীপ্তি অন্য এক কারণে জ্বলজ্বল করত—কারণ সেই জলসার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বড় মিয়া, হামিদুর রহমান।

বড় মিয়া না থাকলে, যেন মাধবীর গলার সুরও মলিন হয়ে যেত। কথা রটত, গানের মূর্ছনা কেবল তার উপস্থিতিতেই পূর্ণতা পায়। মাধবীর হৃদয় গোপনে বন্দি হয়েছিল বড় মিয়ার প্রতি একতরফা প্রেমে—যা কখনো মুখে আনতে পারেননি। কারণ, তিনি জানতেন, ধর্মের ভিন্নতা আর জাতিগত ব্যবধান তাদের মিলনের পথকে চিরকাল অচেনা রাখবে।

এক বছর ভালো ফসল হওয়ায় প্রজারা নিজেরাই খাজনা পরিশোধ করতে এসেছিল, বকেয়া সহ। খুশি হয়ে বড় মিয়া সব বকেয়া মওকুফ করলেন, এবং জলসা ঘর ছেড়ে প্রজাদের সাথে মাঠে মেলায় যোগ দিলেন। সেই রাতে, মাধবী গাইলেন প্রথম গান—

“ওহে কি করিলে পাইব তোমারে রাখিব আখিতে আখিতে…..

প্রজারা তালি দিয়ে, সানাই বাজিয়ে, মাধবীর জয়ধ্বনি করল। কারণ তারা জানত, পালপাড়ার এই মেয়েটি আজ সরদারবাড়ির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। গান শেষে বড় মিয়া মুগ্ধ হয়ে মাধবীর গলায় একটি সোনার চেইন পরিয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে মাধবীর মনে প্রেমের দরজা যেন পুরোপুরি খুলে গেল। তিনি দ্বিতীয় গান ধরলেন—

“আমি এক আধা ফোটা সূর্যমুখী…”

 

কণ্ঠের মায়া যেন আকাশকে থমকে দিল। কিন্তু গান শেষ হওয়ার আগেই, মাধবী মঞ্চে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আসর তড়িঘড়ি সমাপ্ত করা হল। কয়েকদিন পর, খবর এল— মিয়া বাড়িতে এসেছে সদর মহুকুমার রামনগর গ্রামের সরকার বাড়ি থেকে বিয়ের পয়গাম।

প্রস্তাবটি ছিল রাজকীয়—যদি বড় মিয়া কুলসুম সরকারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তবে মেয়ের নামে চারটি জোত লিখে দেওয়া হবে। কুলসুম ছিলেন অনন্য সুন্দরী, যার কেশগুচ্ছ হাঁটুর নিচে ঝুলে থাকত। বিলাসিতার এমন মাত্রা ছিল যে, তিনি সাধারণ গাভীর দুধ ছুঁতেন না; মেয়ের জন্য তাই বিশেষ ভাবে ১২টি লাল গরু উপহার দেওয়া হয়েছিল, যেন নববধূর জন্য বিশুদ্ধ দুধের অভাব না হয়।

বিয়ের দিনে গোয়ালপাড়ার সব গৃহস্থ মিলে ১০ মন দুধ দিয়েছিল নববধূ স্নানের জন্য। গোয়ালপাড়া থেকে আনা হয়েছিল রক্তজবা ফুল, যা দিয়ে সাজানো হয়েছিল পুরো আঙিনা। সেই উৎসবের পর বড় মিয়া গোয়ালপাড়ার গোয়ালিনীরচর মৌজার জমি দান করেন।

কথিত আছে, কুলসুমের দাদার পায়ের পাতার মাপ ছিল আঠারো ইঞ্চি—তার জন্য বিশেষ অর্ডারে জুতো বানাতে হত। ফাগুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিয়ের দিন স্থির হল।

পালপাড়ার নদী ঘাট দিয়ে বড় মিয়ার বিয়ে বহর আসছে। সামনে পালকির বেহারা ঝুকি সুরে একতালে বেহারা বইয়ে নিচ্ছে। পিছনে হাতীর পিঠে নব বধু আর বড় খোলা জানালায় বাংলার রুপ দেখে দেখে ঘরবাধার জাল বুনে এগুচ্ছে।

পালপাড়ার নদীর ঘাটে প্রতি দিনের মত মাধুরী কলমী শাক তুলে স্নান শেষে বাড়ী যাবে। এমন সময় পালকের বহর আর হাতীতে বড় কনে দেখে তার আর বুঝতে বাকি রইল না… মাধবীর একতরফা প্রেম রূপ নিল নীরব যন্ত্রণায়। সেই ব্যর্থ ভালোবাসা তিনি প্রকাশ করলেন কেবল গানে গানে—করুণ সুরে, যা শুনলে মনে হত, যেন কারও অন্তর ছিঁড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা সই

 

দেখতে দেখতে বড় মিয়া হয়ে উঠলেন দুই পুত্র ও দুই কন্যার পিতা। পুত্ররা হলেন—সাইদুর রহমান মিয়া ও হানিফ মিয়া; কন্যারা—সালোমন ও আবুর মা। বড় মিয়ার হাতের দক্ষতা ও তৎপরতা ছিল বাবার জমিদারীর দায়িত্ব পালনে নিখুঁত। তবে তার উদারতা ও দানশীলতা এতটাই প্রশংসনীয় ছিল যে, বৈমাত্রি ভাই আকবর মিয়া ও আহম্মদ মিয়ার দ্বিগুণ জমির হিস্যা থাকলেও, খাজনা ও কর আদায়ে তারা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকতেন। কারণ বড় মিয়া প্রজাদের সকল আবদার মেটাতেন, কখনো কখনো খাজনা মওকুফ করতেন, এমনকি ভুমি ইজারাও বিনামূল্যে দিতেন।

সব গুদারা ও ঘাট ইজারা মুক্ত রাখায়, বৈমাত্রি ভাই আকবর মিয়ার সঙ্গে ছোটখাটো মনোমালিন্যও জন্ম নেয়। আকবর মিয়া ও আহম্মদ মিয়া একত্রে মাত্র তিনটি পরগনার ৬০০ বিঘা জোত পান, অথচ বড় মিয়া এককভাবে তিনটি পরগনার প্রায় ১২০০ বিঘা জোতের অধিকারী হন। আকবর মিয়া গোলীনিরচর, বাঘলদী ও পাতিলাদহ পরগনার জোত নেন, অপরদিকে বড় মিয়া দানশীলতার নিয়মে নদীর তীরবর্তী পরগনা—গোবিন্দ, চরগোয়ালীনী, চার গোবিন্দ ও হিরনধরা—সহ দরিদ্র ও জলমহাল যুক্ত জোতগুলো বণ্টন করেন। এই জোতের কিছু অংশ পরবর্তীতে কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় ৭০০ বিঘা ব্রহ্মপুত্র নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়—এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

আকবর মিয়া ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, বিচক্ষন ও পরহেজগার। তার ভাই আহম্মদ মিয়া, যিনি নিঃসন্তান ছিলেন, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পশ্চিম বঙ্গে মুর্শিদাবাদ চলে যান এবং সেখানেই জীবন সমাপ্ত হয়। পুর্ব বাংলায় থেকে যান বড় মিয়া ও বৈমাত্রি ভাই, যারা স্থানীয় ইতিহাসে নিজের ছাপ রেখে যান।

আকবর মিয়ার দুই পুত্র ও চার কন্যা শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল হয়। বড় ছেলে রশিদ মিয়া দীর্ঘ চার দশক ধরে একাধারে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন—একনিষ্ঠ, প্রভাশালী এবং নির্বাচনমুখী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত। আকবর মিয়ার সন্তানদের নাম ছিল—সন্তানরা: রেজু, সেজু; কন্যারা: ডোর, খুকি, রেবা।

এবার, রুপা সর্দারের বড় ছেলে, হামিদুর রহমান বা বড় মিয়া, এবং তার পুত্র সাঈদুর রহমান মিয়া ও পরবর্তি উত্তরসূরী মজিবুর রহমানের কথা নিয়েই আমরা আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।

সাইদুর রহমান মিয়া (জন্ম ১৮৯০ – মৃত্যু ১৯৬২) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র ও পরহেজগার। তিনি গুরু ট্রেনিং সম্পন্ন এবং আলেমও ছিলেন। নানার বাড়ী রামনগরে যাতায়াতের সুবাদে তিনি আকন্দ বাড়ীর আজগর মাষ্টারের নজরে পড়েন। আজগর মাষ্টার, পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে, সাইদুর রহমানের বিনয়ী ও সুদর্শন ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে, তাঁর বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে উদ্যোগী হলেন।

যদিও হামিদুর রহমান প্রথমে এই বিয়েতে সম্মতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, কুলসুমের প্রবল আগ্রহ এবং পারিবারিক কৌশলের কারণে অবশেষে সম্মতি দেওয়া হলো। এই বিয়ের মাধ্যমে মিয়া বংশের সঙ্গে আকন্দ পরিবারের সমন্বয় ঘটল। কুলসুম পরবর্তীতে বড্ড অনুতপ্ত হয়েছিলেন, কারণ মিয়া–আকন্দ মিলনের ফলে বংশের কিছু অংশের জন্য বিপর্যয়ও আসে।

সাইদুর রহমানের বিয়ে শুধু একটি পারিবারিক মিলনের বিষয় ছিল না; এটি ছিল বংশের মর্যাদা ও প্রভাবের ওপর এক রহস্যময় প্রতিযোগীতার প্রতিফলন। সেই সময় সরকার বংশ ও আকন্দ বংশের মধ্যে চলছিল এক অসম প্রতিযোগীতা—কে কত বড় বংশে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিতে পারে, এটি যেন জুয়ার নেশার মতো মত্ত করে রেখেছিল দুই পরিবারের প্রবীণদের। মেয়েদের উচ্চ বংশে বিয়ে দিতে বাবা কিংবা ছেলের পিতা তালুক পর্যন্ত বিক্রি করতে দ্বিধা করতেন না। ফলে মেয়েদের ধারা উর্ধমুখী ও শিক্ষিত হতে শুরু করলেও, ছেলেরা শিক্ষা ও আর্থিক ক্ষেত্রে অনেকাংশেই পিছিয়ে পড়ত।

এই নিয়তির খেলায় পড়লেন সাইদুর রহমান। কাঁচাসড়া আখন্দ বাড়ীর আজগর মাস্টারে বড় মেয়ে ছাবিরন নেসা —এক অতি সুন্দরী কন্যা, যার পিতার মালিকানাধীন ছিল ৪টি তালুক। ছাবিরনকে মিয়া বংশের ছেলের নিকট বিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। দশ আনা জোতের অধিকারী হামিদুর রহমান বড় মিয়ার ছেলে সাইদুর রহমানের বিষয়ে পয়গাম পাঠানো হল।

বিবাহ পয়গাম আনায়নকারীর হাতে কেবল শব্দই নয়, একটি বলিষ্ঠ দূধালো লাল গাভীও তুলে দেওয়া হল।

বড় মিয়ার কঠোর শর্ত ছিল—“যদি নিজ বেহারায় বিয়ে পাঠানো যায়, তবে আমরা সম্মত।” কিন্তু শর্তটি শোনার পর পয়গাম বাহক স্তব্ধ হয়ে গেলেন। নিজের বেহারা তৈরি করতে হলে আখন্দ বাড়ীর তালুক অর্ধেক খোয়াতে হতো, আর চারজন ডোম পরিবারকে আজীবন খাজনা মুক্ত জীবন-জীবিকা দেওয়ার দায়িত্ব পড়ত।

পয়গাম বাহক শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু আখন্দ বাড়ীর বড় কর্তাকে বিষয়টি জানালে, শিক্ষায় এগিয়ে থাকা এই পরিবার হার মানার পাত্র ছিল না। প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে তাঁরা বিয়ের দিন ঘোষণা করলেন। নির্ধারিত দিনে বর পক্ষ হাতীতে চড়ে আজগর মাষ্টারের বাড়ীতে উপস্থিত হল। ছাবিরন  নিজ বেহারায় পাল্কিতে উঠে গেলেন। সাথে  দুধাল গাভী সহ অনেক উপঢৌকন পাঠান হল।

বড় মিয়া এ দৃশ্য সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না; তিনি এটিকে অপমান হিসেবে গ্রহণ করলেন। সেই অপমানের ছায়া দুই পরিবারের মধ্যে বহুদিন পোহাতে হয়েছিল। ছাবিরন নেসা যখন প্রথম সন্তানের মা হলেন, তার বড় ভাই ভাগ্নের জন্মানুষ্ঠান আয়োজন করে দুই পরিবারের মনমালিন্যের অবসান ঘটালেন। এই প্রথম ছেলের নাম রাখা হল মজিবুর রহমান মিয়া। এর পর ছাবিরন নেসার গর্ভে জন্ম নিল ৪ পুত্র ৪ কন্যা।। তারা হলেনঃ

১) মজিবুর রহমান ২) হাফিজুর রহমান ৩) হাবিবুর রহমান ৪) মোখলেছুর রহমান আর কন্যারা হলেন: ১) ফজিলাতুন্নেছা নেসা ২) জেবুন নেসা জোসনা ৩) শামছুন নাহার চম্পা ৪)  নুরুন নাহার আঙ্গুর।

এভাবেই মিয়া ও সরকার বংশের ইতিহাসে আবেগ, শক্তি, অহংকার ও পারিবারিক প্রতিযোগিতার নাটকীয়তা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে—যেন নদীর স্রোত ও তার তীরে জন্ম নেওয়া গল্পের ছায়া, চিরকাল বংশের স্মৃতিতে ভাসমান।

ফেমেলি ট্রী চার্ট নিন্মরুপঃ

ভাসান সরদার
│
└── রুপা সরদার
    │
    └── কেবরাতুল্লাহ সরদার
        │
        ├── হামিদুর রহমান (বড় মিয়া)
        │   │
        │   ├── সাইদুর রহমান মিয়া
        │   ├── মজিবুর রহমান
        │   ├── হাফিজুর রহমান
        │   ├── হাবিবুর রহমান
        │   ├── মোখলেছুর রহমান
        │   ├── ফজিলাতুন্নেছা নেসা
        │   ├── জেবুন নেসা জোসনা
        │   ├── চামছুন নাহার চম্পা
        │   └── নুরুন নাহার আঙ্গুর
        │
        └── হানিফ মিয়া
    ├── আকবর মিয়া
    └── আহাম্মদ মিয়া

 

জমিদারী থেকে কর্মজীবন:   

          মুজিবুর রহমানের অধ্যায়ঃ

জন্ম ২৬ জুন ১৯১৮ ইং মৃত্যু ২১ জুন ১৯৯৩। 

সংশ্লিষ্ট প্রজন্মে আসেন সাইদুর রহমান এবং তাঁর পুত্র মুজিবুর রহমান। প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল ফুরকানী, যিনি ছিলেন তাঁর ফুফাতো বোন। তাঁদের একমাত্র কন্যা আফরোজা বেগম ছাবিরন নেসার হেফাজতে থাকেন।

১৯৪৭ সাল—উপমহাদেশের আকাশে আঁকা হলো নতুন সীমানা। ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের রেখা শুধু মানচিত্রে টানা হয়নি, তা কেটে দিয়েছিল অগণিত মানুষের জীবন ও সম্পর্কের ভেতরে গভীর ফাটল। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছায়া এসে পড়ল সাইদুর রহমানের পরিবারেও।

জ্যেষ্ঠপুত্র মুজিবুর রহমান—প্রথম স্ত্রী ফুরকানীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ফুরকানী শুধু স্ত্রীই ছিলেন না, ছিলেন তাঁর ফুফাত বোনও। তাঁদের একমাত্র কন্যা আফরোজা বেগম হেলেন। বয়স মাত্র ছয়-সাত বছর। বাবার সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আফরোজা আশ্রয় পেলেন দাদি ছাবিরন নেসার স্নেহভরা কোলের কাছে।

মুজিবুর রহমান তখন জাহাজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন পথের সন্ধানে রেলওয়ের ফুড বিভাগে যোগ দিলেন। দায়িত্ব নিলেন গাইবান্ধা মহুকুমায়। এখানেই পরিচয় হলো স্টাফ হোটেলের পরিচালক মফিজ উদ্দীনের সঙ্গে—যে পরিচয় একদিন হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের নতুন বাঁকের সূচনা।

মফিজ উদ্দীন তাঁকে প্রস্তাব দিলেন—জোতদার ইসহাক উদ্দীনের বড় মেয়ে এফতেদাহ বেগম রুবীকে বিয়ে করার জন্য। রুবী ছিলেন এন্ট্রান্স পড়ুয়া, বুদ্ধিমতী, চেহারায় আকর্ষণীয়। সরকারি চাকুরের স্ত্রী হওয়ার জন্য পারিবারিকভাবে ছিলেন যেন একেবারে উপযুক্ত। ভোলা মিয়া, রুবীর বাবা, প্রস্তাবে রাজি হতে দেরি করলেন না।

বিয়ে ও নতুন শুরু

১৯৫০ সালের ১৭ অক্টোবর—গাইবান্ধা মহুরীপাড়ার বাড়িতে এক সাধারণ অথচ অর্থবহ আয়োজন। মুজিবুর রহমান তখন ২৯ বছরের প্রৌঢ়, রুবী মাত্র ১৮ বছরের কিশোরী। বয়সের ব্যবধান ১১ বছর হলেও সেই দিন হাসি-আনন্দের ঢেউ ঢেকে দিল সব প্রশ্ন।

তবে বাইরে হাসি থাকলেও ভেতরে ভোলা মিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল সমালোচনার তীর—এত বড় বয়সের ব্যবধান মেনে নেওয়া সহজ ছিল না সমাজের চোখে।

রুবীর জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৯। গাইবান্ধা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন তদানিন্তন মহকুমা খাদ্য পরিদর্শক মজিবুর রহমান।  উক্ত অনুষ্ঠানে পরিবেশিত এফতেদা বেগম রুবির একটি গান  মজিবুর রহমানের মন আকৃষ্ট করে। পরবর্তিতে মফিজ মিয়ার প্রস্তাবে তা পূর্নতা পায়। গানটি কি ছিল শুনে নেই।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও —

 বিয়ের তিন বছর পর, ১৯৫০ সালের এপ্রিলে জন্ম নিল তাঁদের প্রথম সন্তান মাহবুবা। সন্তান জন্মের এক বছর আগে রুবী প্রথমবারের মতো শ্বশুরালয়—জামালপুর শ্যামপুর মিয়া বাড়িতে এলেন।

শ্বশুরালয়ে প্রথম পদার্পণ

কিন্তু সেই গৃহ আর আগের মতো ছিল না। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আইনে শ্বশুর সাইদুর রহমান প্রায় সর্বহারা। নদী গিলে নিয়েছে আবাদি জমি, বাকি শুধু জলমহল ও কিছু ইজারা জমি। তবুও পুরনো প্রথা অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন বউকে বরন করার জন্য ১৮ একরের বাগানবাড়ি ভিটা তাঁর নামে দিয়ে দিলেন সাইদুর রহমান।

কিন্তু সুখের আকাশে হঠাৎ জমল কালো মেঘ—ছাবিরন নেসার কাছে থাকা ছোট্ট আফরোজাকে নিয়ে এলো এক গোপন সত্য। মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম বিবাহের কথা রুবীর কাছে আড়াল করেছিলেন। আসলে তিনি নিজে লুকোতে চাননি; ঘটক মফিজ উদ্দীনই তা গোপন রেখেছিলেন। সত্য জানাজানি হওয়ার পর ভোলা মিয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মফিজ উদ্দীনের সঙ্গে কথা বলেননি।

রুবী ব্যথাভরা চিঠি লিখলেন বাবার কাছে। ভোলা মিয়া চিঠি হাতে পেয়েই ছোট ভাই ছৈয়দ আলী মিয়াকে পাঠালেন জামালপুর—মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর সেদিন থেকে রুবী আর কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি পা রাখেননি।

এফতেদাহ বেগম রুবী হয়ে উঠলেন সাত সন্তানের মা—পাঁচ কন্যা, দুই পুত্র। তাঁর জীবন থেমে গেল ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৬-এ, রেখে গেল অনেক স্মৃতি, কিছু আঘাত, আর অনেক অজানা গল্প।

অধ্যায়: পতনের স্রোত ও ছড়িয়ে পড়া জীবন

জমিদারী একসময় শুধু ছিল জমি ও সম্পদের মালিকানা নয়—ছিল ক্ষমতা, ঐতিহ্য আর গৌরবের প্রতীক। হামিদুর রহমান মিয়া, আকবর মিয়া, আহাম্মদ মিয়ার জীবদ্দশায় সেই গৌরবের ছায়া টিকে ছিল—যেন ম্লান হলেও জ্বলন্ত প্রদীপের শেষ আলো।

কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সেই প্রদীপ নিভে গেল। নতুন প্রজন্ম—সাইদুর রহমান মিয়া, হানিফ মিয়া, মোশারফ মিয়া, রশিদ মিয়া স্বাধীনতার পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েন, জমি সংস্কার আইন, আর নদীভাঙনের নির্মম বাস্তবতায় বেড়ে উঠল। একে একে নদী গিলে নিল আবাদি জমি, ইজারা জমি, বাগানবাড়ি—সব।

যে বাগানে একসময় শীতের কুয়াশায় কমলার সুবাস ভেসে আসত, সেখানে আজ কেবল নদীর গর্জন। যে উঠোনে উৎসবের দিনে ঢাক-ঢোল বাজত, সেখানে পড়ে আছে পরিত্যক্ত ইটপাথরের স্তূপ।

জমিদারী হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারাল পারিবারিক ঐক্যও। কেউ ঢাকায় গিয়ে সরকারি চাকরি নিল, কেউ ব্যবসার জন্য নারায়ণগঞ্জে, কেউবা বিদেশে পাড়ি জমাল। গ্রামের ভিটেমাটি হারানো মানুষদের চোখে তখন শূন্যতা—যেন অতীতের স্মৃতিই তাদের একমাত্র ধন।

শীতের রাতে আগুনের পাশে বসে বয়োজ্যেষ্ঠরা বলত —“আমাদের ঘরে একসময় কী জাঁকজমক ছিল!” নবীনরা বিস্মিত চোখে শুনত, কিন্তু কল্পনা করার মতো উপকরণ তাদের হাতে ছিল না।

আর নদী? সে যেন এই পরিবারের নীরব প্রতিদ্বন্দ্বী—ধীরে ধীরে গিলে নিয়েছে তাদের অস্তিত্বের মাটিই।

শেষ পর্যন্ত, সরদার পরিবারের প্রাসাদোপম ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ল অসংখ্য খণ্ডে—যেমন ছিন্ন এক মালার মুক্তো, প্রতিটি দানা ভিন্ন পথে গড়িয়ে গেল। কেউ শহুরে কোলাহলে, কেউ গ্রামীণ নিঃশব্দতায়, কেউবা পরদেশে।

কিন্তু রক্তের ভেতরে, কোথাও গভীরে, এখনও বয়ে চলে সেই পুরনো গৌরবের ক্ষীণ স্পন্দন—যেন সময়ের বুক চিরে আসা কোনো দূরবর্তী ঢেউ, যা হয়তো আর ফিরবে না, কিন্তু যার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতায় এখনও শোনা যায়।

গানের সুর বেজে উঠে হৃদয় গহীনে থেমে থমে

ওপার হতে যারা সাথে এসেছিল —-

১৯৪৭ সালের ১৭ অক্টোবর, মজিবুর রহমান ও এফতেদা রুবীর বিয়ে সম্পন্ন হয়— বয়সের ব্যবধান ছিল প্রায় ১১ বছর। নববধূ রুবীর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর।

বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গমন ঘটে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে।

শ্যামপুর মিয়া বাড়িতে উৎসবের আমেজ, প্রথা অনুযায়ী ১৮ একরের বাগানবাড়ি বরাদ্দ হয় রুবীর নামে।

তবে সব আনন্দ ম্লান হয়ে যায় একটি চিঠিতে। রুবী জানতে পারেন— মজিবুর রহমানের একটি পূর্ববর্তী বিবাহ এবং একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।

এ খবর পেয়েই পিতা ভোলা মিয়া কন্যার চোখের জলে ভেসে পাঠান ছোট ভাই ছৈয়দ আলী মিয়াকে— যিনি রুবীকে নিয়ে যান তাঁর পিত্রালয়ে। এই যাত্রাই হয়ে ওঠে স্থায়ী।

রুবী: আলো ও অন্ধকারের একান্ত পুঁথিঃ 

এই তীব্র আঘাত সত্ত্বেও এফতেদা বেগম রুবী একটি সংগ্রামী জীবন যাপন করেন। তিনি ছিলেন ৫ কন্যা ও ২ পুত্রের জননী। তাঁর জীবনশেষ হয় ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।

রুবী ছিলেন একদিকে বঞ্চনার প্রতীক, অন্যদিকে মা হিসেবে সাহসী এক সংগ্রামীর মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

সরদার বংশের উত্তরসূরি কেমনভাবে পূর্ব বাংলায় জমিদারী রক্ষা ও বংশ বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে গেলেন? কে ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি ব্রহ্মপুত্র পাড়ে শ্যামপুরকে আলোকিত করেছিলেন ?

সম্মান, প্রতিপত্তি ও প্রাচুর্যে গড়া জমিদারী যখন রমরমা, তখনো কেউ ভাবেনি — সময়ের এক প্রবল ধাক্কায় ধ্বসে যাবে এক গৌরবময় ইতিহাস। হামিদুর রহমান মিয়া, আকবর মিয়া এবং আহাম্মদ মিয়ার জীবদ্দশায় জমিদারীর জাঁকজমক ছিল ঈর্ষণীয়। তাদের সময়ে, প্রাসাদ প্রতিম বাড়ি, বিস্তৃত জমি ও কৃষক-ভৃত্যের আনাগোনা এক গৌরবের আবেশ ছড়াত।

কিন্তু সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম—সাইদুর, হানিফ, মোশারফ, রশিদ— এদের যুগে এসে জমিদারী প্রথার করাল গ্রাস শুরু হয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জমিদারদের অবসান ঘটতে থাকে, আর এ বংশেও তার ব্যতিক্রম হয় না।

প্রকৃতি যেন এই পরিণতিকে আরও করুণ করে তোলে। ব্রহ্মপুত্র নদী, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এ জমিদারী, এক সময় সেই নদীর গর্ভেই তলিয়ে যায় অনেক স্মৃতি, ভিটেমাটি। ভেঙে পড়ে জমিদার বাড়ি, বিলীন হয় প্রাসাদ আর খেয়া পারাপারের স্মৃতিচিহ্নগুলো। পরিবারটি ততদিনে ছড়িয়ে পড়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে— কারও ঠাঁই হয় গ্রামে, কারও শহরে; কেউবা বেছে নেয় একান্ত নিভৃতে জীবন, স্মৃতির ভার বুকে চেপে। —

নিরিখ বাইন্ধরে দুই নয়নে — জোহরা আলীম

এবার আসা যাক মজিবুর রহমানের বড় পুত্র এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল মিয়া।  যিনি এই গৌরবময় বংশের ইতিহাসের সংকলক।

জন্ম ৯ মার্চ ১৯৬০ ইং গাইবান্ধা নানার বাড়ী।

মজিবুর রহমানের প্রথম পুত্র: একরামুল হক রুবেল মিয়া

গল্পের পাতা উল্টে আসা যাক এই গৌরবময় বংশের এক বিশেষ অধ্যায়ে—

মজিবুর রহমানের প্রথম পুত্র, এ.কে.এম. একরামুল হক রুবেল মিয়া। তিনি শুধু এই বংশের উত্তরসূরি নন, বরং এই ইতিহাসের নিবেদিত সংকলক ও রক্ষকও বটে।

পাঁচ মেয়ের পর বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তাঁর জন্ম—তাই বাবা-মায়ের অকৃত্রিম স্নেহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর বোনদের কাছেও তিনি যেন চোখের মণি, অনিন্দ্যসুন্দর এক খুশির প্রতীক।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পুত্রের মুখ প্রথম দেখেই মজিবুর রহমান যেন নিজের অন্তরের আনন্দ ধরে রাখতে পারলেন না। সেই উল্লাসে তিনি গোয়ালিনীর চার পরগনার মোট সাড়ে তিন একর জমি সদ্যজাত পুত্রের নামে দানস্বরূপ ঘোষণা করে দলিল লিখে দিলেন।

এসময় এক মজার অথচ অর্থবহ প্রতিশ্রুতির জন্ম হয়। রুবেলের মামা আতাউর রহমান মিন্টু স্নেহভরা চোখে বোনকে বলে উঠলেন—

“বুবু, আমার যদি মেয়ে হয়, তোমার ছেলেকেই আমি তার স্বামী করব। তুমি কথা দাও।” মা রুবী খানম স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলেছিলেন— “ওয়াদা করলাম।”

সময় তার নিজের মতো করে এগিয়ে চলল। রুবেল ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল, কিশোর থেকে তরুণ। শিক্ষায়ও তিনি ছিলেন মনোযোগী ও মেধাবী। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার পর, একদিন ১৯৭৭ সালের শুরুতে, রুবীর কাছে রংপুর থেকে একটি চিঠি এলো—লেখক তাঁর ছোট ভাই, সেই মিন্টু।

চিঠির প্রতিটি বাক্যে যেন একসাথে ভালবাসা, স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতির টান ফুটে উঠেছিল—

“বুবু, তুমি যে কথা দিয়েছিলে ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে, আজ সেই প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমার মেয়ে আফরোজা রহমান মমী এখন চৌদ্দতে পড়ল, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তোমার ছেলে রুবেল ভাল ফল করেছে জেনে বুক ভরে গেল আনন্দে। আমার ইচ্ছে ওকে মেডিক্যালে পড়াব। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ এখন আধুনিকতার প্রতীক। আমি এখানকার রেজিস্ট্রার, আর তোমার ছেলে থাকলে তার পড়াশোনা ও যত্নে কোনো ত্রুটি হবে না, ইনশাআল্লাহ। খরচের বোঝা তোমার কাঁধে নয়, আমি নিজেই নেব। তাছাড়া, আমার কাছে ওকে পাওয়া মানে তোমার দেয়া অঙ্গীকার পূরণ হবে। মাশাআল্লাহ, তোমার ভাতিজিও এখন এমন হয়েছে, দেখে মনে হবে ওদের মিল স্বর্গে লেখা। আশা করি, তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে না।”

চিঠিটি আজও সংরক্ষিত আছে—এক টুকরো কাগজে বন্দি সেই সময়ের অনুভূতি, যা শুধু কথার নয়, দুই পরিবারের সম্পর্কেরও এক অনন্য সাক্ষ্য।

মায়ের সম্মতিতে ১৯৭৭ সালের শুরুতেই রুবেল রওনা দিল রংপুরের পথে। প্রতিশ্রুতি মতো ভর্তি হল রংপুর মেডিক্যাল কলেজে।

কিন্তু— ২য় বর্ষের ১ম সেমিস্টারে এসে দাঁড়াল এক অশনি ছায়ার হাতছানি।

ভাগ্য সবসময় মানুষের স্বপ্নের পথে ফুল বিছিয়ে দেয় না। এক নির্মম পরিহাস অপেক্ষা করছিল সামনে, যা তাদের জীবনের ধারা বদলে দেবে…

আকাশ যেন সেদিন থেকেই কিছু অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছিল—দূরে কালো মেঘ জমাট বাঁধছিল, বাতাস ছিল অদ্ভুত স্থির। পরিবারে প্রবীণরা চুপচাপ বসে কেবল দূর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, যেন তাদের অন্তরে এক অদৃশ্য আশঙ্কা ঘূর্ণায়মান।

সন্ধ্যার আগমুহূর্তে রুবেল নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পানির ঢেউয়ে লেগে থাকা ম্লান আলো যেন তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল—গভীর, কিন্তু অস্থির। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কেন বুকের ভেতর হঠাৎ করেই এক অজানা অশান্তি দানা বাঁধছে।

সবকিছু যেন এক অদৃশ্য হাত লিখে রেখেছিল—একটির পর একটি ঘটনা, যা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কারও ছিল না।

হঠাৎ, সংবাদ এল—যেন বজ্রপাতের মতো। সেই সংবাদে সবার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল, মুখগুলো সাদা হয়ে গেল। কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু কয়েক মুহূর্তেই পুরো পরিবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনের ভেতর যত প্রতিজ্ঞা, যত স্বপ্ন—সব যেন ঝড়ের তাণ্ডবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

রাতের আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ, অথচ সেই আলোয় পুরো মহল্লা ছিল কেমন যেন নিঃসাড়। গাছের পাতা নড়ে উঠছিল হালকা হাওয়ায়, কিন্তু মানুষের চোখে কেবল জল।

ভীরু রুবেল একা বসে ছিলেন উঠানের কোণে, সামনে রাখা পুরনো লণ্ঠনটির ক্ষীণ আলোয় তার মুখ যেন আরও ক্লান্ত, আরও পরাজিত। “এটাই কি তবে আমার নিয়তি?”—তার ঠোঁটে নিঃশব্দে ভেসে এল।

সেই মুহূর্তে মনে হল, ভাগ্য হয়তো মানুষের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসক—যেখানে কোনো আপিল নেই, কোনো দয়া নেই, শুধু পরিহাসের হাসি।

সংকলক একরামুল হক রুবেলের অতীত স্মৃতিময় দিন।

অতীত জীবনের গল্প

সংকলক: এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল

১৯৬০ সালের এক সন্ধ্যায়, রংপুরের আকাশের নিচে, দুটি ভাই-বোন—এফতেদা বেগম রুবী ও আতাউর রহমান মিন্টু—এক অদ্ভুত প্রতিজ্ঞায় বাঁধা পড়লেন। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার টানেই তারা ওয়াদা করলেন, “যার আগে ছেলে হবে, আরেকজনের যদি কন্যা হয়, তবে তাদের পরস্পরকে বিয়ে দেবো।” সেই সময়ের সরলতা আর আত্মীয়তার বাঁধনে এমন প্রতিশ্রুতি ছিল অটুট।

বছর গড়াল।
৯ মার্চ ১৯৬০ সালে রুবীর কোল আলো করে জন্ম নিলো এক পুত্রসন্তান—নাম রাখা হলো রুবেল। আবার ১২ এপ্রিল ১৯৬৬ সালে মিন্টুর ঘরে জন্ম নিলো এক কন্যা—আফরোজা বেগম মমী। দুই পরিবারে দুই শিশু বড় হতে লাগলো, আলাদা শহরে, আলাদা আকাশের নিচে।

সময় বহমান নদীর মতো এগিয়ে গেল। রুবেল হয়ে উঠলো এক মেধাবী ছাত্র।১৯৭৭ সালে এইচ.এস.সি পাস করলো জামালপুর সরকারি কলেজ থেকে। আর তখনও মমী রংপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়সের ফারাক থাকলেও, পুরনো প্রতিশ্রুতির ছায়া ভাসছিল দুই পরিবারের হৃদয়ে।

 মা রুবী চাইতেন, ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হোক, ডাক্তার হোক, আর ভাই মিন্টুর সঙ্গে করা পুরনো ওয়াদা পূর্ণ হোক। তাই তিনি পুত্র রুবেলকে পাঠালেন রংপুর মেডিকেল কলেজে। সেখানেই তখন রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করছিলেন মামা মিন্টু মিয়া। ভাগ্যের ইশারায় রুবেল ভর্তি হলো ১৯৭৭ সালের ব্যাচে।

মামা-মামীর স্নেহ আর আশ্রয়ে রুবেল সুখের দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু সুখ তো কেবলই ক্ষণস্থায়ী—হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার জীবনে।

রুবেল তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঠিক সেই সময়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ আর কারমাইকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতির আগুন জ্বলছিলো। ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্র শিবিরের সংঘর্ষের মধ্যেই ঘটে গেলো এক ভয়াবহ ঘটনা—কারমাইকেলের ছাত্ররা রংপুর মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র চপলকে হত্যা করে। আর চপল ছিল রুবেলের রুমমেট, একই হলে, একই ঘরে থাকতো।

হত্যা মামলার কালো ছায়া এসে পড়লো রুবেলের জীবনে। নির্দোষ হয়েও নাম জড়িয়ে গেলো মামলায়।

মিন্টু মিয়া দিশেহারা। বোনকে কী বলবেন তিনি?
তখন পরামর্শ এলো রংপুর সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র উকিল এডভোকেট সর্দার এম.এ সাত্তারের কাছ থেকে। তার পরামর্শে প্রমাণ সাজানো হলো—“হত্যার তিন মাস আগেই রুবেলকে অনুপস্থিতির কারণে শো-কজ নোটিশে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।” কাগজপত্র শক্ত করা হলো, আর সে প্রমাণের জোরে রুবেল বেঁচে গেলো হত্যা মামলার কালো ফাঁস থেকে।

কিন্তু সেই মুক্তিই ছিল আরেক নতুন কারাবাস—
চিরকালের জন্য রুবেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।

এরপর ধীরে ধীরে মিন্টু মিয়ার মন থেকেও মমী-রুবেলের বিয়ের ওয়াদার কথা হারিয়ে যেতে লাগলো। আর রুবেল ও মমীও, মামাতো-ফুফাতো ভাইবোনের মতো কাটাতে লাগলো দিন।
যেদিন তাদের কানে পৌঁছালো পুরোনো সেই প্রতিশ্রুতির গল্প, তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলো—
“আমরা ভাইবোনই থাকবো, সারাজীবন।”

কারণ মমী জানতো, রুবেলের হৃদয় অন্য কারো জন্য ধুকপুক করছে।

সে হলো গাইবান্ধার তনু ফুফুর মেয়ে—ইভা।
ইভা তখনো ছোট্ট, ক্লাস ফাইভে পড়ে। কিন্তু তার রূপ-লাবণ্য, ফুটফুটে হাসি, শিশুসুলভ ভঙ্গি রুবেলের হৃদয় দখল করে নিয়েছিলো অনেক আগে থেকেই। রুবেল প্রায়ই মমীকে ইভার গল্প শোনাতো, প্রশংসা করতো নিরন্তর। মমীও ইভাকে পছন্দ করতো, যেন আকাশে ঝলমলে তারা।

এইভাবেই, প্রতিশ্রুতি, সংগ্রাম, ভাঙা স্বপ্ন আর এক অদৃশ্য টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলো রুবেলের জীবনযাত্রা…

রুবেল-ইভার সম্পর্ক, জীবনের বাঁকবদল, এবং সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অগ্নিপরীক্ষা

ইভা—গাইবান্ধার তনু খালার মেয়ে। ছোট বেলায় রুবেলের চোখে সে ছিল এক অদ্ভুত জ্যোৎস্না, নিষ্পাপ, লাজুক অথচ আকর্ষণীয়। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ফুটফুটে মেয়ে ইভাকে দেখলেই রুবেলের মন ভরে যেত। হয়তো তখন প্রেমের সংজ্ঞা বোঝেনি সে, কিন্তু হৃদয় গোপনে ইভার নামেই তাল মিলিয়ে বেজে উঠতো।

মমী সব বুঝতো। ইভা যখনই তাদের আলোচনায় আসতো, রুবেলের চোখে এক ধরনের আলো ঝলক দিতো। কিন্তু সে গোপন ভালোবাসা কারো সামনে কখনও ফাঁস হয়নি। এমনকি ইভাও কিছু বুঝতে পারেনি।

বছরের পর বছর কেটে গেলো।
রুবেল তখন রংপুর মেডিকেল কলেজের স্বপ্ন ভেঙে অন্যপথে এগোচ্ছে। ভর্তি হলো পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। নতুন স্বপ্ন, নতুন লড়াই, নতুন গন্তব্য।

কিন্তু ভাগ্যের অদ্ভুত খেলা—
যাকে হৃদয়ে সযত্নে লালন করেছিলো, সেই ইভাকে হঠাৎ তুলে দেওয়া হলো অন্য কারো হাতে।

ইভার বিয়ে হলো এক ধনাঢ্য টেলিফোন বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।
যিনি বয়সে প্রায় বিশ বছরের বড়, কালো রঙের, মুখাবয়বে কোনো আকর্ষণ নেই। তবুও তনু খালা সম্পদ আর উচ্চপদস্থ চাকরির মোহে মেয়েকে সপে দিলেন তার হাতে।

গাইবান্ধা গার্লস স্কুলের পাশে বিশাল প্রাসাদের মতো বাসা, চাকচিক্যময় জীবনের লোভই ছিল মূল টান। পরিবারের অনেকেই এই বিয়েতে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলো, কিন্তু তনু খালার সিদ্ধান্ত অটল ছিল।

রুবেল তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অর্থহীন, ক্ষমতাহীন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ভালোবাসার কথা মুখে আনার মতো পরিবেশ তার ছিল না। প্রতিবাদ করার সাহসও জন্মায়নি।

সে শুধু দূর থেকে দেখলো—
তার শৈশবের ভালোবাসা, হৃদয়ের অজানা কষ্টের নায়িকা, অন্যের ঘরে পা রাখছে।

বিয়ের দিন রুবেল একা এক কোণে বসে ছিল।
কেউ জানলো না তার বুকভাঙা আর্তনাদ। শুধু মমী আঁচ করেছিল, কেন রুবেলের চোখে সেই অদ্ভুত অশ্রুজল।

এরপর থেকে ইভা হয়ে গেলো তার জীবনের চিরন্তন অপুর্ণতার প্রতীক। সারাটা জীবন সেই ব্যথা বয়ে বেড়াতে হলো তাকে। যে স্বপ্নকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল, তা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো এক ঝটকায়।

প্রেমের কথা কখনও প্রকাশ করা হয়নি,
প্রতিরোধও করা হয়নি,শুধু অন্তরালের এক ব্যথা হয়ে রইলো চিরকাল—


যে ব্যথা একদিন রুবেলকে বদলে দিলো ভেতরে ভেতরে।

রংপুর শহরের নীরব বিকেলগুলোতে, মাঝে মাঝে এক চিলতে হাওয়া ভেসে আসতো এডভোকেট এম.এ সাত্তার সাহেবের বাড়ি থেকে। তিনি ছিলেন শহরের সুনামধন্য উকিল, সমাজে সম্মানিত মানুষ। চার কন্যার জনক।

সবার ছোট কন্যা—ওয়াজিফা রহমান বেলী—ছিলো প্রাণোচ্ছল, সরল আর হাসিখুশি এক কিশোরী। তখনো সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী, রংপুর শালবন গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করতো।

ফটো বেলী ১৯৭৯

সাত্তার সাহেবের বাসার উঠোনে সন্ধ্যা নামতেই খেলা জমে উঠতো। ব্যাডমিন্টন খেলার আসরে হঠাৎ একদিন রুবেলের চোখে পড়লো বেলীকে। সেই মুহূর্তে মনে হলো, অন্ধকার রাতের মধ্যে হঠাৎ কেউ যেন আলো জ্বেলে দিয়েছে।

দেখা হলো।
চোখাচোখি হলো।
তারপর আলাপ জমলো।
এভাবেই শুরু হলো পরিচয়ের প্রথম ধাপ।

সময় যত গড়ালো, সেই আলাপ পরিণত হলো মধুর সখ্যে, সখ্য পরিণত হলো অদৃশ্য এক টানে।
রুবেল আগেই শিখেছিল, ভালোবাসা কখনো প্রকাশের সুযোগ না-ও পেতে পারে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো।

বেলীর সরল হাসি, অকৃত্রিম মায়া, আর শিশুসুলভ অভিমান রুবেলের ভেতরে নতুন করে বাঁচার আগুন জ্বালালো।

ভালো লাগা গোপনে ভালোবাসায় রূপ নিলো।
আর সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে পরিচয়ের সোনালি অধ্যায়ে পৌঁছালো।

কিন্তু প্রেমের পথ তো কখনোই মসৃণ হয় না।
বাধা এলো এখানেও।

বেলীর বড় দুলাভাই—রংপুরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী, “এস.এ. আরব এন্ড ব্রাদার্স”-এর মালিক—তিনি ছিলেন কঠোর, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মানুষ।

তার চোখে এই সম্পর্ক ছিলো অবাঞ্ছিত।
তিনি জানতেন, তার পরিবারের মর্যাদা, ব্যবসার ঐতিহ্য আর সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ছোট শালীর বিয়ে হতে হবে সমপদস্থ, ধনী ও ক্ষমতাশালী কোনো পরিবারে।

তাই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন রুবেল ও বেলীর ভালোবাসার বিরুদ্ধে এক অটল প্রাচীর হয়ে।

রুবেল আবারও দাঁড়ালো সেই চিরচেনা অগ্নিপরীক্ষার সামনে। একবার ইভাকে হারিয়ে ছিলো, এবার হারানোর শঙ্কা আরও গভীর হলো।

তবুও, বেলীর সাথে কাটানো দিনগুলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে রইলো।

স্কুলফেরত কিশোরীর সরল হাসি, উঠোনে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট ঘোরানো, ছায়াঘেরা সন্ধ্যার গল্প—সবই একদিন হয়ে উঠলো তার হৃদয়ের অমূল্য সম্পদ।

ভালোবাসা টিকে ছিলো, সামাজিক বাধা ভেঙে বেলী জড়িয়ে গেল রুবেলের জীবন তরীতে।
শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের শাসন মেনে নিলো রুবেল। বিদায় স্মৃতিময় রংপুর শহর ও তার বাসিন্দা।

 

ইভা গাইবান্ধা ২০১০

রংপুর শহর—
যেখানে শৈশব থেকে যৌবন, স্বপ্ন থেকে ব্যর্থতা, ভালোবাসা থেকে বেদনার সবকিছু একসাথে মিলেমিশে আছে।

যেখানে মমীর সাথে ভাইবোনের মতো দিন কাটানো, ইভার প্রতি নীরব আকর্ষণ, আর বেলীর সাথে প্রথম সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ—সবই গাঁথা হয়ে আছে।

রুবেলের জীবনের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি হারানো স্বপ্ন, প্রতিটি সম্পর্ক যেন রংপুরের আকাশে লেখা ইতিহাস।

বিদায় নিলো সে শহর থেকে, কিন্তু বিদায় নিতে পারলো না সেই স্মৃতিগুলো থেকে।


আজও হৃদয়ের গহীনে বাজে এক প্রতিধ্বনি— নজরুল ইসলাম বাবুর লিখা গানের সেই সুর,

” দুই ভুবনে দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল — রেল লাইন বহে সমান্তরাল….

 

বিদায়, স্মৃতিময় রংপুর…”

 অধ্যায়ঃ মল্লিকা বনে শাবানা

শ্যামপুর মিয়া বাড়ির স্মৃতির পাতায় শাবানা

শ্যামপুর মিয়া বাড়ির আঙিনায় যে বাতাস বয়ে যায়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত স্মৃতি, অগণিত গল্প। সেখানেই জন্ম নেয় একদিন এক ফুটফুটে কন্যা, যে রত্না থেকে শাবানা হয়ে ছাপ ফেলবে সমগ্র বাংলার হৃদয়ে।

কিন্তু এর শুরুটা আরও আগে—

জেবুন নেসা জোছনা ছিলেন শ্যামপুর মিয়া বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা। তার বাবা সাইদুর রহমান, ছিলেন বড় মিয়া হামিদুর রহমানের বড় ছেলে। জেবুন নেসার মা ছাবিরন নেছা, আর বড় মামা ছিলেন মজিবুর রহমান। পরিবারের চোখের মণি ছিলেন জোছনা। কে জানত, তার গর্ভেই একদিন জন্ম নেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র—শাবানা।

🌿 বন্ধুত্ব থেকে আত্মীয়তা

১৯৫০ সালের ঢাকা শহর। ব্যস্ত নগরীর এক প্রান্তে ফুট ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন মজিবুর রহমান। সেখানেই নাটকীয়ভাবে পরিচয় হয় এক সুদর্শন, ডগবকে তরুণের সঙ্গে—তার নাম ফয়েজ চৌধুরী।

ফয়েজ চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান চৌধুরী পরিবারের সন্তান। পারিবারিক জটিলতায়, বিশেষত বৈমাতার সঙ্গে বিরোধের কারণে তিনি ১৯৫০ সালে আপন ভিটে ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। অচেনা শহরে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করতে করতে হঠাৎই মজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা। বাস্তবতা ও নৈতিকতায় ভরা এই তরুণের চরিত্রে এমন কিছু ছিল, যা দেখে মজিবুর রহমান মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল গভীর বন্ধুত্ব।

বন্ধুত্বের সূত্র ধরে ফয়েজ চৌধুরীর যাতায়াত শুরু হলো শ্যামপুর মিয়া বাড়িতে। সুদর্শন রূপ, ভদ্রতা আর চরিত্রের দৃঢ়তায় তিনি মুহূর্তেই মুগ্ধ করে ফেললেন পুরো পরিবারকে।

একদিন মজিবুর রহমান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন—এই বন্ধুত্বকে শুধু ক্ষণিকের নয়, চিরস্থায়ী করে তুলবেন। তাই তিনি তাঁর ছোট বোন জেবুন নেসা জোছনাকে ফয়েজ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার প্রস্তাব দিলেন বাবা-মাকে। পরিবারও দ্বিমত করল না।

💍 এক নতুন সূচনা

১৯৫২ সালের মার্চ মাসে ফয়েজ চৌধুরী ও জেবুন নেসা জোছনার বিয়ে হলো।


ফয়েজ ছিলেন চমৎকার হাতের লেখার অধিকারী এবং তদানীন্তন সময়ের দক্ষ সাঁটলিপিকার। বিয়ের পর দুই বন্ধু—মজিবুর রহমান ও ফয়েজ চৌধুরী—একই ছাদের নিচে হাতিরপুলে বসবাস শুরু করলেন।

বন্ধুত্বের বাঁধন আরও দৃঢ় হলো। মজিবুর রহমানের সহায়তায় ফয়েজ চৌধুরী যোগ দিলেন ঢাকা সুপ্রিম কোর্টে মুদ্রাক্ষরিক পদে। জীবনের ছন্নছাড়া পথ তখন রূপ নিল স্থিতিশীলতায়।

নতুন প্রাণের আগমন

ক্রমে উভয় বন্ধুর পরিবার পূর্ণতা পেতে শুরু করল।
১৯৫২ সালে মজিবুর রহমানের ঘরে জন্ম নিল এক কন্যা—আফরোজা রহমান হেলেন।
এরপর ১৯৫৪ সালে আরেক কন্যা এল—মাহবুব রহমান বেলুন।

বন্ধুর আনন্দ ভাগাভাগি করার যেন এক অদ্ভুত মিলনমেলা চলছিল। ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে ফয়েজ চৌধুরীর ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ফুটফুটে কন্যা। পরম আদরে তার নাম রাখা হলো—আফরোজা চৌধুরী রত্না।

বন্ধুর ঘরে যেমন আফরোজা, তেমনি নিজের ঘরে একই নাম রেখে যেন মজিবুর ও ফয়েজের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হলো।

কিন্তু ভাগ্য রত্নার জন্য এক ভিন্নতর অধ্যায় রচনা করেছিল। সেই রত্নাই পরবর্তীতে হয়ে উঠবে বাংলার চিত্রপর্দার মায়াবী নায়িকা—শাবানা।

🌺 রত্না থেকে শাবানা

রত্না নামটি একদিন পাল্টে গেল শাবানা হয়ে। নাম বদলের পেছনেও ছিল এক মজার ঘটনা, এক মধুর কাহিনি—যা পরে আলোকপাত করা হবে। তবে এটুকু সত্য, রত্নার আঙুল ধরেই মল্লিকা বনে শাবানা ফুটেছিল, আর আলো ছড়িয়েছিল পুরো বাংলার সিনেমার জগতে।

রত্না থেকে শাবানানা নামের আড়ালে এক স্বপ্নের জন্মঃ

আফরোজা চৌধুরী রত্না—একটি ঘরের আদুরে নাম। বাবা ফয়েজ চৌধুরী ও মা জেবুন নেসা জোছনার পরম যত্নে বেড়ে ওঠা এই মেয়ে ছিল যেন পরিবারের নয়নের মণি।

কিন্তু নিয়তি তার কপালে বুনে রেখেছিল অন্য এক পরিচয়, অন্য এক নাম, যা শুধু পরিবারের নয়—সমগ্র দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বাজবে।

🎥 সিনেমার দোরগোড়ায়

রত্না বড় হতে হতে অসাধারণ সৌন্দর্য, লাবণ্য ও অভিনয়ের স্বাভাবিক প্রতিভা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করলেন।চলচ্চিত্র জগতের এক পরিচালক ( মুস্তাফিজ) একদিন তার প্রতিভার দীপ্তি চিনে ফেললেন।
বললেন— “এই মেয়েটির চোখে যে জ্যোতি, তা শুধু ঘরের চার দেওয়ালের জন্য নয়। ওর জন্য রুপালি পর্দাই উপযুক্ত।”

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ১৯৬৬ সালের ২৯শে জুলাইয়ের দিনটি এক বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে।

মুস্তাফিজ পরিচালিত “ডাক বাবু” নামের ছবিটি সেদিন মুক্তি পেয়েছিল ঢাকায়—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সাদা-কালো আলোছায়ার সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুজাতা, আজিম, শবনম, দীপ্তি ও মনজুর মতো তারকারা। কিন্তু সিনেমার খণ্ড দৃশ্যে হঠাৎ করেই পর্দায় দেখা মেলে এক কিশোরীর—রত্না। তার সাথেই ছিলেন তরুণ রাজ্জাক, যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠবেন বাংলা চলচ্চিত্রের চিরচেনা নায়ক।

এই ছবির একটি দৃশ্যে, ষ্টেশন মাস্টারের ভূমিকায় ছিলেন রত্নার মামা মজিবুর রহমান, আর ওয়েটিং রুমের যাত্রী বন্ধু হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন ফয়েজ চৌধুরী। পারিবারিক আবহ, শৈশবের সরলতা ও আকস্মিক সুযোগ—সবকিছু মিলে রত্নার সেই প্রথম পর্দায় আবির্ভাব হয়ে উঠেছিল চলচ্চিত্র জগতের অমূল্য সূচনা।

যদিও ডাক বাবু ছবিটি বক্স অফিসে তেমন জোরালো সাড়া ফেলতে পারেনি, তবুও এখান থেকেই রাজ্জাক ও রত্নার চলচ্চিত্র যাত্রার প্রথম ধাপ শুরু হয়। রাজ্জাকের জন্য সেই পথ খুলে দেয় পরবর্তী বেহুলা ছবির নায়কোচিত খ্যাতি, আর রত্নার জন্য ছিল অপেক্ষায় আরেক বিস্ময়কর অধ্যায়।

সেই ডাক বাবু সিনেমার একটি গান শুনা যাক। ওগো তুমি দুরে থেকে —-

 

রত্না থেকে শাবানা—নামকরণের গল্প

রত্নার কিশোরী অভিনয় দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন বিখ্যাত পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশাম। তখন তিনি কাজ করছিলেন তার বহুল প্রতীক্ষিত ছবি “চকোরী”-তে। নায়ক হিসেবে নির্ধারিত ছিলেন নাদিম, আর নায়িকা হওয়ার কথা ছিল শবনম। কিন্তু শবনম নানা কারণে ছবির চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ালে, এহতেশামের চোখে পড়ে সেই নবীনী—রত্না।

চলচ্চিত্রের প্রথা মেনে কিংবা হয়তো নতুন পরিচয় গড়ার ইচ্ছায়, এহতেশাম প্রস্তাব দিলেন নতুন নামের। তিনি রাখতে চেয়েছিলেন “শাবানা”। পরিচিতজন ফয়েজ চৌধুরীর চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে, রত্না সহজেই তা মেনে নিলেন।

ফয়েজ চৌধুরী, যিনি ছিলেন উচ্চ নৈতিকতার মানুষ, বললেন—“নাম বদলালে আমার মেয়ে বদলে যাবে না। সে যেখানেই থাকুক, শিকড়ের কথা ভুলবে না।”

পরে অবশ্য এই নাম রূপ নিল “শাবানা”য়—যা এক সময় হয়ে উঠল পুরো বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রতীকী নাম।

১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া চকোরী ছবিটি ছিল শাবানার নায়িকা হিসেবে প্রথম পূর্ণাঙ্গ অভিনয়। ছবিটি মুক্তির পর সাড়া জাগায় পুরো দেশজুড়ে। টানা ৮১ সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চলতে চলতে এটি লাভ করে হিরক জয়ন্তীর সম্মান। নিগার পুরস্কারসহ বহু স্বীকৃতি এই ছবিকে অমর করে রাখে, আর শাবানা নামের অভিনেত্রীকে পৌঁছে দেয় আকাশ ছোঁয়া খ্যাতিতে।

চকোরী সিনেমার একটি দৃশ্যে শাবানা 

 

এক নামের আড়ালে এক কাহিনি

রত্না হয়তো ভাবেননি তার সরল পদচারণা একদিন শাবানা নামে কিংবদন্তি হয়ে উঠবে। ডাক বাবুর ছোট্ট দৃশ্য থেকে শুরু করে চকোরীর বিশাল সাফল্য—প্রতিটি ধাপ ছিল যেন তার জীবনের নতুন অধ্যায়। নামের পরিবর্তন শুধু পরিচয় বদল নয়, ছিল এক সৃষ্টিশীল যাত্রার সূচনা।

এভাবেই রত্না থেকে শাবানা হয়ে ওঠা—এক কিশোরীর সাধারণ সূচনা থেকে কিংবদন্তি নায়িকার জন্মকথা—বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে।

নতুন আলোকচ্ছটাঃ

শাবানা নামটি যেন আশ্চর্য জাদু বয়ে আনল।
সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেল খ্যাতি, সম্মান ও ভালোবাসা। চলচ্চিত্রে একের পর এক চরিত্রে অভিনয় করে তিনি হয়ে উঠলেন লক্ষ মানুষের হৃদয়ের রানী।

শাবানা নামটি যেন আশ্চর্য জাদু বয়ে আনল।
সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেল খ্যাতি, সম্মান ও ভালোবাসা।

চলচ্চিত্রে একের পর এক চরিত্রে অভিনয় করে তিনি হয়ে উঠলেন লক্ষ মানুষের হৃদয়ের রানী।

কিন্তু পর্দার শাবানার অন্তরে তিনি আজীবন থেকে গেলেন রত্না— শ্যামপুর মিয়া বাড়ির উঠোনে বেড়ে ওঠা এক অসাধারণ মেয়ে রত্না। 

 জেবুন নেসা জোছনা (স্বামী: ফয়েজ চৌধুরী) তিন পুত্র তিন কন্যার জননী।  পুত্ররা হলেনঃ

১) আবিদুর রেজা চৌধুরী রিজভী,

২) আবিদুর মুরছা লিন রিপন,

৩) আব্দুস সালেহীন শাহিন

 কন্যারা হলেনঃ   

১) আফরোজা সুলতানা রত্না (শাহানা),

২) নাসরিন সুলতানা রঞ্জিতা।

৩) তাহমিনা সুলতানা রিতা। 

তারা সবাই আমেরিকায় বসবাস করেন। 

হামিদুর রহমান মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র হানিফ মিয়ার অধ্যায়ঃ


সাহসী ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন তিনি। মায়ের মতই (কুলসুম) অত্যন্ত সুদর্শন। তাঁর বিয়ে হয় মাহমুদপুর মিয়া বাড়ির মনির উদ্দীন সরকারের কন্যা রহিমন নেসার সঙ্গে। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে চান মিয়া ও এক মেয়ে ননী। দুধে আলতা গায়ের রং ছিল বলে মেয়ের নাম ননী রেখেছিলেন বাবা হানিফ মিয়া। দুর্ভাগ্যবশত, হানিফ মিয়া অকালমৃত্যু বরণ করেন।কুলকান্দীতে বোনের বাড়িতে রান্নাঘরের চুলায় পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

হানিফ মিয়ার উত্তর সূরীঃ

ছেলে: চান মিয়া (মাহমুদপুর মিয়া বাড়ি)।

মেয়ে: ননী। বিয়ে হয় ভাটারা মহিষাবাদুরিয়া ময়েজ উকিলের সঙ্গে।

চান মিয়ার সন্তান  সমূহ: ৪ ছেলে ১ মেয়ে।

১) মনোয়ার হোসন
২) দেলোয়ার ( 01312989920)
৩) সরোয়ার হোসেন
৪) আনোয়ার  হোসেন (মৃত)
মেয়ে: রিমী

ননীর সন্তান সমূহ: ২ ছেলে ১ মেয়ে।

১) আব্দুর রউফ – ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব। 

২) শামছুল হক (আবু) — লন্ডনে দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে বর্তমানে ঢাকায়

 মেয়েঃ ফিরোজা — স্বামী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

অধ্যায় : হানিফ মিয়া ও তাঁর উত্তরসূরিরা

সাইদুর রহমান মিয়ার কন্যা জোছনা যেমন ছিল বংশের গৌরব, তেমনি হামিদুর রহমান মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র হানিফ মিয়াও ছিলেন তাঁদের পরিবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুঠাম দেহ, সাহসী চিত্ত আর মায়ের (কুলসুমের) মতো রূপমাধুর্যে ভরপুর ছিলেন তিনি। গ্রাম্য জীবনে তিনি যেন ছিলেন এক দৃঢ় বাঁশের মতো—যে ঝড়েও ভেঙে পড়ে না, কেবল মাথা নোয়ায়।

হানিফ মিয়ার বিয়ে হয় মাহমুদপুর মিয়া বাড়ির মর্যাদাবান ব্যক্তি মনির উদ্দীন সরকারের কন্যা রহিমন নেসার সঙ্গে। সংসার আলো করে তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় দুই সন্তান—এক পুত্র ও এক কন্যা।

পুত্রের নাম রাখা হয় চান মিয়া, আর কন্যাকে বাবা স্নেহভরে ডাকেন ননী। কেননা শিশুকন্যার দুধে-আলতা গায়ের রঙে যেন ফুটে উঠেছিল শৈশবের সরলতা ও অনন্য সৌন্দর্য।

কিন্তু ভাগ্য সবসময় সৌভাগ্য লিখে দেয় না। অকালেই মৃত্যুর করালগ্রাসে নিভে যায় হানিফ মিয়ার জীবনপ্রদীপ। কুলকান্দীতে বোনের বাড়িতে এক দুর্ঘটনায় রান্নাঘরের চুলায় পড়ে গিয়ে তাঁর করুণ মৃত্যু ঘটে। তরতাজা জীবন হঠাৎ নিভে গেলে যেমন বাগানের একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল হঠাৎ ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনই পরিবারে নেমে আসে শোকের অন্ধকার।

তবু রক্ত ধারার শিকড় কেটে যায় না। সন্তানরা জীবনের স্রোতধারায় বয়ে চলে পরিবারের ইতিহাসকে।

চান মিয়াঃ

চান মিয়া মাহমুদপুর মিয়া বাড়িতে বেড়ে ওঠেন। দায়িত্বশীল পিতার অনুপস্থিতিতেও তিনি নিজের সংসারকে গড়ে তুলেছিলেন দৃঢ় মাটিতে। তাঁর সন্তান ছিল ৪ পুত্র ও ১ কন্যা:

১) মনোয়ার হোসেন (কানডায় বসবাস করেন)

২) দেলোয়ার (01312989920)

৩) সরোয়ার হোসেন

৪) আনোয়ার হোসেন (ইন্তেকাল করেছেন)

এবং এক কন্যা — রিমী।

ছবিতে মনোয়ার তার ছেলে ও সংকলক 

হানিফ মিয়ার একমাত্র কন্যা ননীঃ

ননী বড় হন বাবার ভালোবাসার স্মৃতি বুকে নিয়ে। তাঁর বিয়ে হয় ভাটারা মহিষাবাদুরিয়ার সম্মানিত ব্যক্তি ময়েজ উকিলের সঙ্গে। সংসারে আসে তিন সন্তান—দুই পুত্র ও এক কন্যা। পুত্রঃ

১) আব্দুর রউফ — যিনি কর্মজীবনে পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেশের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব (অব.) পদে উন্নীত হন।

২) শামছুল হক (আবু) — লন্ডনে দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি ঢাকায়।

একমাত্র কন্যা ফিরোজা — যাঁর স্বামী ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট।

এইভাবে হানিফ মিয়ার বংশধারা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রজন্মে—কেউ রাষ্ট্রসেবায়, কেউ বিদেশ বিভুঁইয়ে, আবার কেউ আপন পরিবারে স্মৃতির অমূল্য ভান্ডার রচনা করে।

হানিফ মিয়ার জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাঁর বংশধরদের মাধ্যমে তিনি আজও বেঁচে আছেন—কখনো সন্তানের নামের পাশে, কখনো নাতির কীর্তিতে, কখনো রক্তের টানে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়তার বন্ধনে।

হানিফ মিয়ার জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাঁর বংশধরদের মাধ্যমে তিনি আজও বেঁচে আছেন—কখনো সন্তানের নামের পাশে, কখনো নাতির কীর্তিতে, কখনো রক্তের টানে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়তার বন্ধনে।

এভাবেই শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে মিয়া পরিবারের ইতিহাস। প্রতিটি প্রজন্ম যেন নতুন করে বুনে যায় স্মৃতির রেশ, আবার জড়িয়ে থাকে পুরোনো শেকড়ে। জোছনার আলোকচ্ছটায় যেমন ভেসে আসে সাইদুর রহমানের পরিবারের রঙিন অধ্যায়, তেমনি হানিফ মিয়ার বংশধরদের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পায় ঐতিহ্যের অনন্য মহিমা।

হানিফ মিয়ার সন্তানদের পদচিহ্ন মুছে যায়নি কালের ধুলোয়। তাঁদের বংশধররা হয়ে উঠেছিল একেকটি উজ্জ্বল প্রদীপ, যারা আলোকিত করেছে পরিবারের পথ।

চান মিয়ার ছেলেরা—মনোয়ার, দেলোয়ার, সরোয়ার ও আনোয়ার—ছিলেন সেই প্রদীপের শিখা। কারো জীবন কেটে গেছে শিক্ষায়-জ্ঞানে, কারো জীবন সংসারের নীরব সংগ্রামে। রিমী নামের কন্যাটি ছিল পরিবারে স্নেহের ছায়া, যাঁর হাসি আজও আত্মীয়তার স্রোতে ভেসে আসে।

অন্যদিকে, ননীর সন্তানরাও ছিলেন ইতিহাসের গর্বিত অংশ। আব্দুর রউফ রাষ্ট্রসেবায় দেশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন; শামছুল হক দূর লন্ডনের মাটিতে থেকেও মাতৃভূমিকে ভুলে যাননি; আর ফিরোজা—একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সহধর্মিণী হয়ে থেকেছেন পরিবারের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক।

এভাবে প্রতিটি নাম হয়ে উঠেছে একেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম, প্রতিটি জীবন যেন ইতিহাসের পাতায় খোদাই হয়ে থাকা অক্ষর।

কিন্তু পরিবার কেবল সাফল্য বা সম্মানের গল্প নয়; এটি রক্তের, ভালোবাসার, ত্যাগের গল্প। পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সেই গল্প আরও গভীর রূপে ফুটে ওঠে। নতুন যুগ, নতুন পথ, নতুন স্বপ্ন—তাদের জীবনকে নিয়ে যায় আরও বিস্তৃত দিগন্তের দিকে।

যেমন সাইদুর রহমান মিয়ার কন্যা জোছনা আলো ছড়িয়েছিলেন এক অধ্যায়ে, তেমনি হানিফ মিয়ার উত্তরসূরিরা ছড়িয়ে দেন আরেক অধ্যায়ের আলো।

আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে আরেকটি নতুন কাহিনি—যেখানে পুরোনো দিনের আবেগ, সম্পর্কের গভীরতা ও পরিবারের মহিমা মিলেমিশে রচনা করবে পরবর্তী অধ্যায়ের গল্প।

 

এবারের অধ্যায়ে সাইদুর রহমানের অবশিষ্ঠ ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা ও তাদের উত্তরসূরী সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

অধ্যায় – “সাইদুর রহমান মিয়া”

১৮৯০ সালের প্রভাত-আলোয় জন্ম নিয়েছিলেন তিনি—সাইদুর রহমান মিয়া (১৮৯০ – ১৯৬২)। স্বভাবত শান্ত, লাজুক অথচ দীপ্তিময়। তাঁর অলংকার ছিল বিনয়, পরিচয় ছিল নম্রতা, আর অন্তরের অমূল্য ধন ছিল পরহেজগারিতা। তিনি একাধারে গুরু-ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষিত আলেম, অন্যদিকে পারিবারিক শিষ্টাচারের উজ্জ্বল প্রতীক।

বিয়ের গল্প

রামনগরের নানা বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে পরিচয় ঘটে কাঁচাসরা নিবাসী আকন্দ বাড়ির পঞ্চায়েত প্রধান আজগর মাস্টারের সঙ্গে। সুদর্শন, মার্জিত ও জ্ঞানমুখর এ তরুণ সাইদুর রহমানকে দেখে আজগর মাস্টার মুগ্ধ হয়ে যান। মনে মনে ভাবলেন—“এমন চরিত্রবান যদি জামাই হয়ে আসে, তবে পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক পঞ্চায়েত উভয়ই হবে দৃঢ়তর।”

এদিকে সরকার বাড়ির দানশীল কর্তা—‘দানভাই’ নামে পরিচিত জন, মধ্যস্থ হয়ে প্রস্তাব আনেন। তখনও জীবিত ছিলেন দাদা কেবরাতুল্লাহ সরদার—গ্রামের এক মহীরুহ, যার ছায়ায় পল্লিজীবন বেঁচে থাকত নিশ্চিন্তে।

বাবা হামিদুর রহমান—প্রতাপশালী ভূস্বামী, যাঁর অধীনে আট জোত, ছয় তালুক, অসংখ্য প্রজা ও খাজনা আদায়ের বাহক। অথচ এমন ক্ষমতাবান মানুষও ছিলেন অদ্বিতীয় মানবিকতায় ভরা। তালুকদার হয়েও খাজনা আদায়ে ছিলেন অনিচ্ছুক। প্রজাদের কষ্ট দেখে গোদারা ঘাটের খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন। প্রতিবছর নিজের জমি বিক্রি করে সরকারি কর পরিশোধ করেছেন—এমন নিঃস্বার্থ ভূস্বামী আর ক’জন ছিল!

এই গৃহে জামাই হওয়ার প্রস্তাব প্রথমে অনিচ্ছাসূচক ছিল। কিন্তু মা কুলসুম বিবির অনুরাগী ইচ্ছায় বাবার মন গলল। মা চেয়েছিলেন—দেশের ঘরের মেয়ে হোক ছেলের বউ, যাতায়াত সহজ হোক। আর পুত্র সাইদুর রহমান ছিলেন আজ্ঞাবহ সন্তান, তাই শেষমেশ বিয়ে ঠিক হল।

ভাঙনের সূচনা

কিন্তু সময়ের পরিহাস—এই বিয়ে হয়ে উঠল ভবিষ্যতের মোড় ঘোরানো অধ্যায়। মিয়া বংশে আকন্দ পরিবারের সংযুক্তি যেন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভাগ্যের দরজা খুলে দিল। একে একে জোত-তালুক, প্রজা সব হারিয়ে গেল। ভ্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাস গ্রাস করে নিলো সবুজ ধানের খেত, পৈতৃক ভিটেমাটি।

খাজনা দিতে না পারায় শেষ সম্বলও বিক্রি হলো প্রভু গৌরিপুরের কাছে। অবশিষ্ট যা ছিল তাও গেলো খাস খতিয়ানভুক্ত হয়ে। ঐশ্বর্যশালী পরিবারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল—কেউ জামালপুর, কেউ শেরপুর, কেউবা ঢাকায়। যে আঙিনায় উৎসব হতো, সেখানে আর ফিরল না কেউ।

সাইদুর রহমান গিয়ে উঠলেন জামালপুর কাঁচাসরায় শ্বশুর আজগর মাস্টারের বাড়িতে। হানিফ মিয়া আশ্রয় নিলেন মাহমুদপুরে, আকবর মিয়ার বংশধর ঢাকায়। শুধু হেমায়েত মিয়ার তিন পুত্র—মোশারফ, এনায়েতুর রহমান ও খালেক মিয়া—মেলান্দহ এলাকায় থেকে গেলেন, নিরুপায় হয়ে।

এক উত্তরাধিকারীর অন্তিম দৃশ্য

১৯৩৮ সালে ৯০ বছর বয়সে দাদা কেবরাতুল্লাহ সরদার মৃত্যুবরণ করলেন। হানিফ মিয়া ছিলেন বড় ভাই সাইদুর রহমানের অনুগত। তিনি আলাদা কোনো অংশ চাননি, ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে বাস করতেন। কিন্তু বিধি বাম—ভ্রহ্মপুত্র সবকিছু গিলে খেল। সরকার জমি খাস খতিয়ানভুক্ত করল, আর হানিফ মিয়া বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি মাহমুদপুরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে একদিন কুলকান্দীতে বোনের বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অকালেই প্রাণ হারালেন।

পরিশিষ্ট

এভাবেই ভেঙে গেল এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ভিত্তি। ব্রহ্মপুত্র ভাসিয়ে নিয়ে গেল শুধু ভূমি নয়, ভাসিয়ে নিয়ে গেল সম্পর্কের শেকড়ও।

আজও মনে পড়ে যায় বাগিচা-বাড়ির চৌচালা ঘরের ছেলেবেলার দিন, হাসি-খেলার ধ্বনি। আর হৃদয়ে গুনগুনিয়ে ওঠে সেই গান—

চিরদিন কাহারো সময় সমান।নাহি যায় __

 

সাইদুর রহমান মিয়ার স্ত্রী: ছাবিরন নেসা এর ৪ পুত্র ৪ কন্যা।

১)  মজিবুর রহমান।

২)  হাফিজুর রহমান,

৩)  হাবিবুর রহমান,

৪)  মোখলেছুর রহমান,

চার কন্যাঃ
১) ফজিলতন নেসা,
২) জেবুন নেসা জোছনা,
৩) শামসন নাহার চম্পা
৪) নুরুন্নাহার আঙুর

১) মজিবুর রহমান (স্ত্রী: এফতেদা বেগম রুবী) এর ২ পুত্র ৬ কন্যা।পুত্র (২ জন):

১) এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল
২) এ,কে,এম ইনামুল হক জুয়েল।

কন্যা (৬ জন):

কন্যা: 

১) আফরোজা রহমান হেলেন (১৯৪৮ –২০২১) ২) মাহবুবা রহমান বেলুন (১০ নভেম্বর ১৯৫১) ৩) মাহমুদা রহমান হাসি (২১ আগস্ট ১৯৫৪)   ৪) মাকছুদা রহমান খুশি (১৯ এপ্রিল ১৯৫৬) ৫) মাহফুজা রহমান লিপি (২২ মে ১৯৫৮)    ৬) মুনছুরা রহমান ডলি (৭ জুন ১৯৬২)

২) হাফিজুর রহমান স্ত্রী: ঝামেলা বেগম এর ২ পুত্র ৩ কন্যা।

১) রফিকুর রহমান,হারুন
২) শফিকুর রহমান,তরুন

মেয়েদের নামঃ
১) শাহিদা বেগম নিলু।
২) সাজেদা বেগম জিলু।
৩) শাহিনা বেগম পিলু।

৩) হাবিবুর রহমান স্ত্রী বানেছা খাতুন এর পুত্র নাই ৮ কন্যা।কন্যারা হলেনঃ

হাবিবুর রহমান মজনু এর ৮ মেয়ে।

১) মনোয়ারা খাতুন মনি। জং নাসির উদ্দীন
২) সাজেদা বেগম রানী।
৩) ফরিদা বেগম (মৃত) জং আঃ বারেক।
৪) হাসনা হেনা জং হেলাল উদ্দিন।
৫) নার্গিস আক্তার লাকি। জং আমজাদ ।
৬) শাম্মী আক্তার চায়না।
৭) তানজিনা আক্তার সোমা।
৮) হালিমা আক্তার রিমা।

মোখলেছুর রহমান স্ত্রী আনোয়ারা, আন্জু ও লাভলী। এদের এক পুত্র ২ কন্যা।

১) তাবিবুর রহমান লিটন,
কন্যাঃ ১) ঝরনা, ২) তাহমিনা রহমান পান্না

১) ফজিলতন নেস স্বামী গোলাম রসুল এর ২ পুত্র ২ কন্যা।

১) তাজুল ইসলাম সুলতান
২) আমিনুল ইসলাম সাহেব

কন্যা ১) দুলারী, ২) শেফালী

২) জেবুন নেসা জোছনা। স্বামী: ফয়েজ চৌধুরী এর ৩ পুত্র ৩ কন্যা। পুত্র গন

১) আবিদুর রেজা চৌধুরী রিজভী,
২) আবিদুর মুরছা লিন রিপন,
৩) আবদুস সালেহীন শাহিন,

কন্যা

১) আফরোজা বেগম রত্না (শাবানা),
২) নাসরিন সুলতানা রনজিতা।
৩) তাহমিনা সুলতানা রিতা।

৩) শামছুন্নাহার চম্পা (মৃত) হামিদুর রহমান মন্টু। ঢাকায়। ৩ ছেলে ৪ মেয়ে।

  • ক) ছেলেঃ জিয়াউর রহমান সেলিম। ঢাকা। 01715440099
  • খ) শহীদুর রহমান ভুট্টু। 01789869141
  • গ) শফিকুর রহমান শফিক। ঢাকা ।01798674649
  • ক) হুসনা আরা মায়া 01752806842
  • খ) রোকেয়া আক্তার মিনু 01992621634
  • গ) মালা ( নিরুদ্দেশ)
  • ঘ) ফারিহা ইয়াসমিন পলি 01934349970
  • ৪) নুরুন্নাহার আঙ্গুর জং মৃত আবুল হোসেন। ঢাকা । ২ ছেলে ৩ মেয়ে।
  • ক) ছেলেঃ গালিব। ঢাকা।
  • খ) ছেলেঃ সোয়েব । ঢাকা।
  • ক) মেয়েঃ পারভীন । আমেরিকা।
  • খ) মেয়েঃ শিরীন।  ঢাকা।

 

এবার আসা যাক কেবরাতুল্লাহ ২য় পুত্র এনায়েতুল্লাহ সরদারের বংশ সিড়ি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্ব। 

কেবরাতুল্লাহ সরদারের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন এনায়াতুল্লাহ সরদার।তাঁর দুই সন্তান—

১. পুত্র: হেমায়েতুল্লাহ মিয়া
২. কন্যা: নাম অজ্ঞাত

হেমায়েতুল্লাহ মিয়া

হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার পরিবার যেন এক নদীর মতো, যেখান থেকে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। তাঁর দুটি পক্ষ ছিল—

প্রথম স্ত্রীর গর্ভে: ১ পুত্র, ২ কন্যা

দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে: ২ পুত্র

স্ত্রী রহিমন নেসার সঙ্গে মিলিতভাবে তিনি গড়ে তোলেন এক বিস্তৃত পরিবার, যা মেলান্দহ থেকে ইসলামপুর থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

জীবনের প্রতিটি প্রবাহের মাঝে যেমন নদীর স্রোতধারা থাকে, তেমনি এক পরিবারের ইতিহাসও বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এমনই এক প্রবাহ হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার পরিবার, যার শিকড় বিস্তার করেছে মেলান্দহ থেকে ইসলামপুর থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত। হেমায়েতুল্লাহ মিয়া এবং তাঁর স্ত্রী রহিমন নেসার —চার পুত্র, দুই কন্যা—এই ইতিহাসের মূল আধার।

হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার উত্তরাধিকারঃ

এক সময়ের গম্ভীর ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হেমায়েতুল্লাহ মিয়া ছিলেন সরদার বংশের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, নদীভাঙনের বিপর্যয়ের মধ্যেও তাঁর পরিবার টিকে থেকেছে মেলান্দহ ও আশপাশের জনপদে—ঠিক যেন প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক অদম্য বটবৃক্ষ।
তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন রহিমন নেসা, যাঁর কোমলতা আর দৃঢ়তায় গড়ে উঠেছিল একটি বিস্তৃত পরিবার—চার ছেলে ও দুই মেয়ের ছায়াতলে।

হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার সন্তানগণঃ

১. গোলাম সরোয়ার (বৈমাত্রিক)
২. মোশারফ মিয়া
৩. খালেক মিয়া
৪. এনায়েতুর রহমান মিয়া (বাচ্চু মিয়া)

কন্যা দুইজনঃ
১. নয়ার মা — স্বামী ছিলেন মাহবুব পণ্ডিত ওরফে মহব্বল মাস্টার; যাঁর দৈহিক গঠন এতই স্থূল ছিল যে, লোকমুখে প্রচলিত, তিনি যখন বায়ু ত্যাগ করতেন, তখন দাসীদের তার পা তুলে ধরতে হত! তাঁদের বাড়ি ছিল পণ্ডিতবাড়ি, চিকাজানী, দেওয়ানগঞ্জে।

২. জাহেরা (সেতারার মা) — স্বামী ছিলেন মৌলভী আবুল ফজল মিয়া, কুলকান্দী মিয়াবাড়ির ইসলামপুরের একজন সম্মানীয় অধিবাসী।

প্রথম পুত্র গোলাম সরোয়ারের কোন ইতিহাস সংরক্ষিত নেই।

হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার দ্বিতীয় সন্তান মোশারফ মিয়া। জীবন যুদ্ধে অবিচল এই মানুষটি রেখে গেছেন একটি সুগঠিত পরিবার—চার পুত্র, দুই কন্যা।

পুত্রগণঃ
১. শাহজাহান মিয়া সাজু (মৃত) — রেখে যান দুই ছেলে (হাবিব, রকেট) ও দুই কন্যা (শিরিন, ইতি)। তাঁরা মেলান্দহে বসবাস করেন।

২. আনোয়ার হোসেন পানু — একমাত্র ছেলে হাদী ও কন্যা আরিফাকে নিয়ে বসবাস করেন ঢাকার নন্দীপাড়ায়।

৩. আব্দুর রাজ্জাক (ডিপটি) (মৃত) — রেখে যান এক পুত্র রাকিব, ও দুই কন্যা বুলবুলি ও রাবেয়া। তাঁরা মেলান্দহ ও ঢাকায় ছড়িয়ে আছেন।

৪. মিজানুল হক মনি — বসবাস ঢাকার নন্দীপাড়ায়। পুত্র তাজবীহ (ডেন্টিস্ট) ও কন্যা তাসলীর জনক।

কন্যাগণঃ
১. নূরজাহান বেগম মুক্তা — স্বামী রিয়াজ মিয়া, ঝারকাটা মাহমুদপুর নিবাসী। তাঁদের চার কন্যা: রিপা, রেহেনা, সাহানা ও শাবানা এবং একমাত্র পুত্র সিদ্দিক।

২. আফরোজা বেগম মুক্তা — স্বামী রউফ মিয়া, বারইপাড়া মেলান্দহের অধিবাসী। তাঁদের সন্তান: পুত্র ফারুক এবং কন্যা কাজল ও চম্পা।


চতুর্থ পুত্র এনায়েত মিয়া ওরফে বাচ্চু মিয়া ছিলেন বহুল পরিচিত। তাঁর জীবন দুই পর্বে বিভক্ত—প্রথম পক্ষ ইসলামপুরে এবং দ্বিতীয় পক্ষ জামালপুরে।
দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন সাইদুর রহমান মিয়ার ভায়রা ময়েন মৃধার কন্যা।

এই দুই দাম্পত্যজীবনে তিনি হয়েছেন আট পুত্র ও পাঁচ কন্যার জনক। দুর্ভাগ্যবশতঃ পুত্রদের মধ্যে একজন ছাড়া সকলেই ইন্তেকাল করেছেন। তবে তাঁর পাঁচ কন্যা আজও জীবিত ও পরিবার-পরিজনসহ সুপ্রতিষ্ঠিত।

✳ উপসংহার
হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার এই রক্তধারা আজ বিস্তৃত একটি বংশে পরিণত হয়েছে। নানা চরিত্র, নানা গন্তব্য, নানা গল্পের সমাহারে গড়ে উঠেছে এক বিশাল পরিবার—যারা বয়ে নিয়ে চলেছে পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার, স্মৃতি ও আত্মত্যাগ।

এনায়েত মিয়া (বাচ্চু) ও তার উত্তরসূরি
সময়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এক প্রজন্মের নাম—এনায়েত মিয়া, যিনি পরিবারের কাছে ছিলেন ‘বাচ্চু’ নামে পরিচিত। তাঁর জীবন ও কর্মে জড়িয়ে আছে এক যুগের নিঃশব্দ সাক্ষ্য। তিনি রেখে গেছেন এক বিশাল পরিবার, যার শাখা-প্রশাখা আজও ছড়িয়ে আছে নানা প্রান্তে, নানা রূপে।

তাঁর পুত্রগণ:
১) বাদশা মিয়া — সময়ের গর্ভে বিলীন, নিঃসন্তান এই মানুষটির জীবনের গল্প যেন এক অসমাপ্ত অধ্যায়।
২) ঠান্ডা মিয়া — তিনিও প্রয়াত। রেখে গেছেন এক পুত্র, সৌকত এবং এক কন্যা, পপি—যাঁরা বাবার স্মৃতিকে বয়ে চলেছেন আজও।
৩) নান্নু মিয়া — মৃত্যুর পূর্বে রেখে গেছেন তিন কন্যা: নাছিমা, নাজমা ও ফাতেমা। তাঁরা পিতার নাম অমলিন রেখেছেন নিজ নিজ সংসারে।
৪) রাজা মিয়া — তাঁর উত্তরসূরিতে রয়েছে তিন পুত্র: হাফিজুল, রাসেল ও রাশেদ এবং এক কন্যা রাজিয়া।
৫) বাবুল মিয়া — নিঃসন্তান অবস্থায়ই জীবনের পাঠ শেষ করেন।
৬) মসকুট মিয়া — দেশের সেবায় ছিলেন নিয়োজিত, বিডিআরে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী লাইজু ইসলামপুরে বসবাস করছেন, স্মৃতির ভার বয়ে।
৭) মোনছব মিয়া — আজও বেঁচে থাকা এই একমাত্র পুত্র, যিনি তাঁর ভাইদের স্মৃতি বুকের গভীরে ধারণ করে আছেন।
৮) রফিক মিয়া তিনিও প্রয়াত। রেখে গেছেন একমাত্র পুত্র পাপন, যিনি বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন।
উপসংহার
হেমায়েতুল্লাহ মিয়ার রক্তধারা বয়ে চলেছে নদীর মতো—কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। এনায়েত মিয়ার অগণিত সন্তান-সন্ততির ভেতর দিয়ে বংশটি বিস্তার লাভ করেছে, রেখেছে উত্তরাধিকার ও স্মৃতির অমোঘ দাগ।

এই ইতিহাস তাই শুধু একটি পরিবারের বর্ণনা নয়—এ হলো সময়ের স্রোতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাহিনী, বেদনা ও আনন্দের মিশ্রণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত এক অনন্ত যাত্রা।

হামিদুর রহমানের বোনের উত্তরসূরি
হামিদুর রহমানের এক বোন ছিলেন, যার নাম বিস্মৃত হয়েছে কালের অতলে। তবে পরিবারে তাঁকে “মোকাদ্দেসের মা” নামেই ডাকা হতো। তাঁর স্বামী ছিলেন আবু মিয়া, নিবাস ইসলামপুরের কুলকান্দী মুন্সীবাড়ীতে।

তাঁদের একমাত্র পুত্র মোকাদ্দেস মিয়া, যিনি রেখে গেছেন দুই পুত্র: ১) মনু মিয়া (প্রয়াত) ২) খাজা মিয়া  কুলকান্দীর সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে সুপরিচিত।

মনু মিয়ার পুত্র শাহীন বর্তমানে কুলকান্দীর চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত। পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার যেন আজও তাঁকে নেতৃত্বের মঞ্চে আগলে রেখেছে।

হামিদুর রহমানের ফুফাতো/চাচাতো ভাইয়েরা

পরিবারের বিস্তার শুধু সরাসরি উত্তরাধিকারে নয়, বরং পার্শ্বশাখাতেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

আফজল হোসেন মিয়া
তালেব হোসেন মিয়া
সাদেক হোসেন মিয়া (সদর মিয়া)

তাঁদের জীবনও এই বংশগাঁথার অংশ, যা মিলে মিশে এক বিশাল ইতিহাস রচনা করেছে।

 

এবার রুপা সরদারের তৃতীয় পুত্র: ইরাতুল্লাহ সর্দার ও তার উত্তর সূরী দের নিয়ে আলোচনায় আসছিঃ

ইরাতুল্লাহর কোনও পুত্র ছিল না। তাঁর তিন কন্যা:

ইরাতুল্লাহ সরদারের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর তিন কন্যা ছিলেন—

১) আতর নেছা
২) আজিজুন্নেসা
৩) কামরুন্নেসা

আতর নেছা

আতর নেছার সন্তানদের বিষয়ে তথ্য সীমিতভাবে পাওয়া যায়। জানা যায়, তাঁর একটি পুত্র ছিলেন।

 আজিজুন্নেসা

(তথ্য অসম্পূর্ণ, পরিবারের বংশধারা নিয়ে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।)

 কামরুন্নেসা

কামরুন্নেসার বিয়ে হয় প্রফেসর আব্দুস সবুর সিদ্দিকীর সঙ্গে। পিতা: ইরাতুল্লাহ সরদার, ইসলামপুর পালপাড়া।তাঁদের সন্তানরাঃ

পুত্রগণঃ

১) আব্দুর রউফ সিদ্দিকী — চির কুমার; ফরিদপুর, পূর্ব খাবাসপুর নিবাসী।

২) আব্দুর রব সিদ্দিকী — অবসরপ্রাপ্ত ডিপুটি সেক্রেটারি। ১ পুত্র, ৫ কন্যার জনক।

৩) আজিজুর রহমান সিদ্দিকী (কালা খোকা) — জনতা ব্যাংকের রিজিওনাল ম্যানেজার ছিলেন।

মিতব্যয়ী অথচ পরিবারের সবার প্রতি আন্তরিক এই মানুষটি ঢাকায় দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে অবসরজীবন কাটিয়েছেন ফরিদপুরে তাঁর নিজস্ব বাসভবন “পদ্মরাগ”-এ।

ছিলেন দুই পুত্র (পান্থ, বিত্ত) ও তিন কন্যার (তন্নী, বহ্নি, পিউ) জনক।

লেখকের স্মৃতিতে তিনি অত্যন্ত প্রিয়, স্নেহশীল ও সহায়ক ব্যক্তিত্ব। তাঁর সুস্থ জীবনধারা, ঝকঝকে দাঁত, এবং মিষ্টি কথোপকথন আজও মনে পড়ে।

পান্থ ছিলেন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট, তন্নী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পারিবারিক স্মৃতিতে তাঁর নাম বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে।


৪) মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী (দেলু) — তিন পুত্র (দীপু, দোহা, তো্হা) ও তিন কন্যার (দীবা, জেবা, জেনী) জনক।

কন্যাগণঃ

১) লতিফা খাতুন — স্বামী সৈয়দুর রহমান, সরদারপাড়া, জামালপুর।

তিন পুত্র: ড. আতাউর রহমান হেলাল (প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), আমিনুর রহমান ফিরোজ (জিএম, অপসোনিন), কামাল (ঢাকা)।

চার কন্যা: রাশেদা খাতুন এমেলী, রুবী, ছবি, ডেইজি। সকলে কর্মজীবী।


২) রাজিয়া মজিদ বেগম — স্বামী শাহ আহম্মদ মো. মজিদ, এডভোকেট ও সাবেক এমএলএ।

নিবাস: খুলনা, তেরখাদা।

রাজিয়া বেগম স্মৃতিকথা “জোনাকীর আলো জ্বলে” নামে একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে পরিবারের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত বইটির কোনো কপি আজ আর নেই।

একমাত্র কন্যা লিপি, বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।


৩) সালেহা খাতুন রেণু — স্বামী ডাঃ খন্দকার আব্দুল করিম, মিরপুর, ঢাকা।

চার কন্যা:

বাচ্চুমনি (স্বামী আনিছুর রহমান চৌধুরী)

কাজল (স্বামী আবুল কালাম আজাদ; তাঁদের সন্তান তৌসিফ)

শেলী (স্বামী সেলিমা বদরুজ্জামান; স্থায়ীভাবে আমেরিকায়)

বেবী (স্বামী নাফিসা করিম; স্থায়ীভাবে আমেরিকায়)

৪) সেলিমা বেগম (আঙ্গুর) — স্বামী মৃত মজিবর রহমান; আগারগাঁও, ঢাকা।

এক পুত্র রুপন (ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকা)

তিন কন্যা: রীমা (স্বামী কর্নেল), রুহী (স্বামী ম্যাজিস্ট্রেট), রাহী (আমেরিকায় স্থায়ী)।


৫) মনিরা বেগম (মনু) — স্বামী ইঞ্জিনিয়ার ও নাট্যকার, ঢাকা।

ইরাতুল্লাহ সরদারের বংশধারা যদিও পুত্রসন্তান দ্বারা প্রবাহিত হয়নি, তাঁর কন্যাদের মাধ্যমে এটি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। একদিকে ফরিদপুরের পদ্মরাগের অঙ্গন, অন্যদিকে লস অ্যাঞ্জেলসের উজ্জ্বল আলো—সবখানেই আজ তাঁর উত্তরসূরিদের পদচিহ্ন বিদ্যমান।

এই পরিবারে যেমন রয়েছে শিক্ষাবিদ, ব্যাংকার, ডাক্তার ও আমলা, তেমনি রয়েছে শিল্পী, সাহিত্যিক ও নাট্যকার।

স্মৃতির স্রোতে ভেসে আসে—

“জল রঙে আঁকা ছবি জলে মিশে যায়, মুছে না সে রঙ যে রঙ মেখেছ তোমার পাখায়…”


ঠিক তেমনি ইরাতুল্লাহ সরদারের কন্যাদের রঙিন উত্তরাধিকার আজও অমলিন হয়ে আছে তাঁদের সন্তানের সাফল্য, জীবনযাত্রা ও স্মৃতি গাথায়।

 

জমিদারী প্রথার অবসান ও বিলুপ্তীর কথাঃ

গৌরবের উত্তরাধিকারঃ 

ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষা শ্যামপুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ভাসান সরদারের জমিদারবাড়ি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই বাড়ি ছিল শক্তি, গৌরব আর ঐশ্বর্যের প্রতীক। সাত প্রজন্মের জমিদারি—যেখানে প্রজারা ভোর হলে মাথা নিচু করে জমিদারের চৌহদ্দি অতিক্রম করত, যেখানে উঠোনে প্রতিধ্বনিত হতো ঘোড়ার খুরের টাপুর-টুপুর শব্দ, যেখানে নকশিকাঁথায় মোড়ানো পালকিতে জমিদার পরিবার যাতায়াত করত।

সরদার নামটি শুধু উপাধি নয়, ছিল এক গৌরবময় পরিচয়—একটি শক্তি, একটি ইতিহাস।

নদীর হাহাকারঃ

কিন্তু মানুষের গড়া দুর্গও টিকতে পারে না প্রকৃতির নির্মমতার কাছে। যখন হামিদুর রহমান বড় মিয়ার ঘরে ছোট্ট হানিফ মিয়ার জন্ম হলো, তখনই নীরবে এক অমঙ্গল ছায়া নেমে এলো।

ব্রহ্মপুত্র নদী—যেন এক অদম্য দানব। প্রবল স্রোতে কেটে নিতে লাগল চরের বুক। একে একে গোয়ালিনীরচর, গোবিন্দী আর পাতিলাদহ পরগনার সোনালী ফসলের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। রাতারাতি গ্রাস হয়ে গেল ভিটেমাটি, চাষীদের কপালে জমল অশ্রু।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে যেমন, তেমনি ভেঙে পড়ল সরদার পরিবারের স্বপ্ন।

প্রজাদের পাশে জমিদারঃ

এই ভয়াল সময়ে প্রকাশ পেল হামিদুর রহমান বড় মিয়ার মহত্ত্ব। তিনি জানতেন—প্রজা যদি না টিকে, জমিদারি অর্থহীন। তাই তিনি প্রজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একে একে সব বকেয়া খাজনা মওকুফ করে দিলেন।

প্রজারা বিস্মিত! জমিদার তো সাধারণত কড়া হন, কিন্তু তাদের জমিদার অন্যরকম। তিনি খাজনা চাননি, বরং দাঁড়ালেন প্রজাদের পাশে। তিনি ঝালপাড়া আর পালপাড়ার অসহায় পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিলেন, তাদের জন্য বাতিল করলেন জলমহলের ইজারা চুক্তি।

প্রজারা তখন বলেছিল—
“আমাদের জমিদার শুধু জমিদার নন, তিনি আমাদের পিতা।”

প্রথার অবসানঃ

কিন্তু সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ১৯৫০ সাল—পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর হলো পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন। শত শত বছরের জমিদারি প্রথা বিলীন হয়ে গেল এক কলমের আঁচড়ে।

সরদার পরিবারের ২১০০ বিঘার মধ্যে মাত্র তিন-চার শত বিঘা জমি থেকে গেল, বাকিটুকু চলে গেল সরকারের দখলে।
সাইদুর রহমান, হামিদুর রহমানের পুত্র, চোখে জল নিয়ে দেখলেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের মৃত্যু। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল—
“এই তবে শেষ? সাত প্রজন্মের ইতিহাস মুছে যাবে এভাবে?”

নদীর দ্বিতীয় আঘাত

কিন্তু নদীর ক্ষুধা তখনো শেষ হয়নি। ১৯৫৪ সালে ব্রহ্মপুত্র আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল জমিদারির ভিটেমাটির ওপর। অবশিষ্ট জমিও চলে গেল নদীর তলদেশে।

সাইদুর রহমান ভেঙে পড়লেন। চার পুত্র ও চার কন্যাকে নিয়ে তিনি চলে এলেন জামালপুর মহকুমার বেলটিয়া গ্রামে। রাজসিক জমিদারবাড়ি হারিয়ে আজ তিনি এক ভিটেমাটি হারা সাধারণ মানুষ। সেই ভাঙা দিনের কান্না ঢেকে রেখেছিল পুরো পরিবারকে। এক বিশাল বংশ ভেঙে ছড়িয়ে গেল—কেউ ঢাকা, কেউ টাঙ্গাইল, কেউ শেরপুর।

দীর্ঘ সময় পরে, ১৯৮২ সালে নদীর বুক থেকে কিছু চর আবার ভেসে উঠল। কিন্তু সরদার বংশ আর পুরনো জমিদারির দাবি করল না। স্মৃতিজড়িত জমি প্রজাদের হাতেই রয়ে গেল।
শুধু ১৮ বিঘা বাগানবাড়ি রাখা হলো স্মৃতির খাতিরে। যেন পুরনো ইতিহাসের ভগ্ন প্রতীক।

সময় গড়িয়ে যায়। ২০০৫ সালে এক উত্তরসূরি সংকলক ফিরে আসেন ব্রহ্মপুত্রের তীরে। সূর্যাস্তের আলোয় নদীর বুক লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে অশ্রুতে।

তার মনে পড়ে যায় পূর্বপুরুষের গৌরব, প্রজাদের কান্না, নদীর করাল থাবা। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে এক গানের সুর—

“সকাঁতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোন শোন পিতা…”

পরিবার বংশ তালিকা (Family Tree)

হামিদুর রহমান মিয়া (বড় মিয়া)
├── সাইদুর রহমান মিয়া (১৮৯০–১৯৬২)
│   ├── মজিবুর রহমান (নুদু মিয়া)
│   │   ├── এ.কে.এম. একরামুল হক (রুবেল)
│   │   ├── এ.কে.এম. ইনামুল হক (জুয়েল)
│   │   ├── আফরোজা রহমান (হেলেন)
│   │   ├── মাহবুবা রহমান (বেলুন)
│   │   ├── মাহমুদা ইয়াসমিন (হাসি)
│   │   ├── মাকছুদা রহমান (খুশি)
│   │   ├── মাহফুজা রহমান (লিপি)
│   │   └── মুনছুরা রহমান (ডলি)
│   ├── হাফিজুর রহমান (দুদু মিয়া)
│   ├── হাবিবুর রহমান (মজনু মিয়া)
│   ├── মোখলেছুর রহমান (তারা মিয়া)
│   ├── ফজিলতন নেসা (গেন্দী)
│   ├── জেবুন নেসা (জোসনা)
│   ├── শামছুন্নাহার (চম্পা)
│   └── নুরুন্নাহার (আঙ্গুর)
├── হানিফ মিয়া
│   ├── চান মিয়া
│   │   ├── মনোয়ার
│   │   ├── দেলোয়ার
│   │   ├── সরোয়ার
│   │   ├── আনোয়ার (মৃত)
│   │   └── রিমী
│   └── ননী
│       ├── আব্দুর রউফ
│       ├── শামছুল হক (আবু)
│       └── ফিরোজা
└── হেমায়েত মিয়

তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরসূরি:

ভাসান সরদার + ফারাহ ইয়ামেনী
│
├── রুপা সরদার
├── কেবরাতুল্লাহ সরদার
│   ├── হামিদুর রহমান বড় মিয়া
│   │   ├── সাইদুর রহমান মিয়া
│   │   │   ├── মজিবুর রহমান
│   │   │   ├── হাফিজুর রহমান
│   │   │   ├── হাগিবুর রহমান
│   │   │   ├── মোখলেছুর রহমান
│   │   │   ├── ফজিলাতুন নেসা
│   │   │   ├── জেবুন নেসা জ্যোৎসনা
│   │   │   ├── শামছুন নাহার চম্পা
│   │   │   └── নুরুন্নাহার আঙুর
│   │   ├── হানিফ মিয়া
│   │   │   ├── চান মিয়া
│   │   │   │   ├── মনোয়ার হোসেন
│   │   │   │   ├── দেলোয়ার হোসন
│   │   │   │   ├── সরোয়ার হোসেন
│   │   │   │   ├── আনোয়ার হোসেন
│   │   │   │   └── রিমী
│   │   │   └── ননী
│   │   └── রশির মা
│   ├── আকবর মিয়া
│   ├── আহাম্মদ মিয়া
│   ├── ছালেমন
│   └── আবুর মা
├── হেমায়েতুল্লাহ সরদার
├── এনায়েতুল্লাহ সরদার
└── রুপমা
├── সোনা সরদার
├── ইরাদ সরদার
└── ভিকু সরদার

হামিদুর রহমান মিয়া (বড় মিয়া)
├── সাইদুর রহমান মিয়া (১৮৯০–১৯৬২)
│   ├── মজিবুর রহমান (নুদু মিয়া)
│   │   ├── এ.কে.এম. একরামুল হক (রুবেল)
│   │   ├── এ.কে.এম. ইনামুল হক (জুয়েল)
│   │   ├── আফরোজা রহমান (হেলেন)
│   │   ├── মাহবুবা রহমান (বেলুন)
│   │   ├── মাহমুদা ইয়াসমিন (হাসি)
│   │   ├── মাকছুদা রহমান (খুশি)
│   │   ├── মাহফুজা রহমান (লিপি)
│   │   └── মুনছুরা রহমান (ডলি)
│   ├── হাফিজুর রহমান (দুদু মিয়া)
│   ├── হাবিবুর রহমান (মজনু মিয়া)
│   ├── মোখলেছুর রহমান (তারা মিয়া)
│   ├── ফজিলতন নেসা (গেন্দী)
│   ├── জেবুন নেসা (জোসনা)
│   ├── শামছুন্নাহার (চম্পা)
│   └── নুরুন্নাহার (আঙ্গুর)
├── হানিফ মিয়া
│   ├── চান মিয়া
│   │   ├── মনোয়ার
│   │   ├── দেলোয়ার
│   │   ├── সরোয়ার
│   │   ├── আনোয়ার (মৃত)
│   │   └── রিমী
│   └── ননী
│       ├── আব্দুর রউফ
│       ├── শামছুল হক (আবু)
│       └── ফিরোজা
└── হেমায়েত মিয়া

এই অংশটুকু সরদার বংশের সেই উপাখ্যান, যেখানে সময়, সম্পর্ক ও উত্তরাধিকারের প্রবাহ মিলে সৃষ্টি করেছে একটি জীবন্ত ইতিহাস। এখানেই লুকিয়ে আছে শত বছরের ধ্বনি—ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে এক গৌরবময় উপহার।

স্মৃতির সরণি বেয়ে রক্তের ধারা…

কালের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে যখন পেছন ফিরে দেখি, দেখি স্মৃতির ধুলিমাখা অক্ষরে লেখা কিছু নাম, কিছু মুখ—যাঁরা আমার পূর্বপুরুষ, যাঁরা এই ইতিহাসের জীবন্ত পাথেয়। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন সাইদুর রহমান মিয়া, এক বংশশ্রেণির আভিজাত্য যাঁর শিরায় শিরায় প্রবাহিত ছিল।

আজ এই লেখার পরিসমাপ্তি টানতে গিয়ে হৃদয়ের কোনে কান্নার এক অদৃশ্য রেখা বয়ে যায়। একেকটি নাম, একেকটি গল্প—আমার পূর্বপুরুষ, আমাদের শেকড়। “গানের সুর জাগে হৃদয়ে —

বেলা বয়ে যায় ছোট্ট মোদের পানসী নৌকা –

বংশের ইতিহাস মানে শুধু নামের তালিকা নয়, বরং সময়ের প্রবাহে গড়ে ওঠা প্রেম, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্মৃতির এক জলছবি। এই ইতিহাস আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের অস্তিত্বের ভাষ্য।

এই লিখাটি শুধুমাত্র একটি পারিবারিক ইতিহাস নয়—এ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের জন্য প্রেরণা, গর্ব আর চিরন্তন ভালোবাসার দলিল।

হয়তো কেউ বলবে, “এ তো কেবল অতীত…” আমি বলবো —”না, এ হলো ভবিষ্যতের বীজ, যা রোপণ করেছি আমি ইতিহাসের বাগানে, একরামুল আর তার সন্তানদের জন্য।”

 শেষ কথা:

যখন সময় থেমে যাবে, কালের ঘড়িতে শেষ ঘণ্টা বাজবে, তখনো এই নামগুলো থাকবে অক্ষয়—এই ইতিহাস হবে আমাদের উত্তর সূরির পাথেয়।

আল্লাহ যেন আমাদের পূর্ব পুরুষদের জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্তরে স্থান দেন,আর আমাদের উত্তরসূরিদের সত্য ও আদর্শের পথে অটুট রাখেন।

– সমাপ্ত –

 

পরিবার বংশ তালিকা (Family Tree)

 

ভাসান সর্দার

├── রুপা সর্দার
│ ├── কেবরাতুল্লাহ সর্দার
│ │ ├── হামিদুর রহমান বড় মিয়া
│ │ │ ├── সাইদুর রহমান
│ │ │ │ ├── মজিবুর রহমান
│ │ │ │ │ ├── এ,কে,এম একরামুল হক
│ │ │ │ │ └── এ,কে,এম এনামুল হক
│ │ │ │ ├── হাফিজুর রহমান
│ │ │ │ ├── হাবিবুর রহমান
│ │ │ │ └── মোখলেছুর রহমান
│ │ │ ├── হানিফ মিয়া
│ │ │ ├── জানের মা
│ │ │ └── রাশির মা
│ │ ├── আকবর মিয়া
│ │ ├── আহম্মদ মিয়া
│ │ ├── ছালেমন (কন্যা)
│ │ └── কুসুম কলি (কন্যা)
│ ├── হেমায়েতুল্লাহ সর্দার
│ ├── এনায়েতুল্লাহ সর্দার
│ └── রুপমা (কন্যা)

├── সোনা সর্দার

└── ভিকু সর্দার

 

সংকলক এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল

 

পরিবার বংশ তালিকা (Family Tree)

ভাসান সর্দার

├── রুপা সর্দার
│ │
│ ├── কেবরাতুল্লাহ সর্দার
│ │ │
│ │ ├── হামিদুর রহমান (বড় মিয়া)
│ │ │ │
│ │ │ ├── সাইদুর রহমান
│ │ │ │ │
│ │ │ │ ├── মজিবুর রহমান
│ │ │ │ │ │
│ │ │ │ │ ├── এ.কে.এম. একরামুল হক
│ │ │ │ │ ├── এ.কে.এম. এনামুল হক
│ │ │ │ │ ├── আফরোজা রহমান (হেলেন)
│ │ │ │ │ ├── মাহবুব রহমান (বেলুন)
│ │ │ │ │ ├── মাহমুদা রহমান (হাসি)
│ │ │ │ │ ├── মাকসুদা রহমান (খুশি)
│ │ │ │ │ ├── মাহফুজা রহমান (লিপি)
│ │ │ │ │ └── মুনছুরা রহমান (ডলি)
│ │ │ │ │
│ │ │ │ ├── হাফিজুর রহমান
│ │ │ │ ├── হাবিবুর রহমান
│ │ │ │ └── মোখলেছুর রহমান
│ │ │ │
│ │ │ ├── ফজিলাতুন্নেছা
│ │ │ ├── জেবুন নেসা জোছনা
│ │ │ ├── শামছ্ননাহার (চম্পা)
│ │ │ └── নুরুন্নাহার (আঙুর)
│ │ │
│ │ ├── হানিফ মিয়া
│ │ ├── জানের মা
│ │ └── রাশির মা
│ │
│ ├── আকবর মিয়া
│ ├── আহম্মদ মিয়া
│ ├── সালেমন
│ └── কুসুমন

├── হেমায়েতুল্লাহ সর্দার
├── এনায়েতুল্লাহ সর্দার
└── রুপমা

ভাসান সর্দার
└── স্ত্রী: ফারাহ ইয়ামেনী
    └── রুপা সর্দার
        └── স্ত্রী: আম্বর নেসা
            └── কেবরাতুল্যা সর্দার
                └── স্ত্রী: আতর নেসা ও চন্রাবলি
                    └── হামিদুর রহমান বড় মিয়া
                        └── স্ত্রী: কুলসুম অধিকারী
                            ├── সৈয়দ সাইদুর রহমান
                            │   └── স্ত্রী: ছাবিরন নেসা
                            │       ├── পুত্র: সৈয়দ মজিবুর রহমান
                            │       │   └── স্ত্রী: এফতেদা বেগম রুবী
                            │       │       ├── পুত্র: এ,কে,এম একরামুল হক রুবেল
                            │       │       ├── পুত্র: এ,কে,এম এনামুল হক জুয়েল
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা ইশরাত জাহান, সৈয়দা ইফতেখার জাহান লুবনা, সৈয়দা ইশনিয়াত জাহান লিপসী
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা আফরোজা রহমান হেলেন
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা মাহবুব রহমান বেলুন
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা মাহমুদা রহমান হাসি
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা মাকসুদা রহমান খুশি
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা মাহফুজা রহমান লিপি
                            │       │       └── কন্যা: সৈয়দা মুনছুরা রহমান ডলি
                            │       ├── ২য় পুত্র: সৈয়দ হাফিজুর রহমান
                            │       │   └── স্ত্রী: ঝামেলা বেগম
                            │       │       ├── পুত্র: সৈয়দ রফিকুর রহমান, সৈয়দ শফিকুর রহমান
                            │       │       ├── কন্যা: সৈয়দা শাহিদা আক্তার নীলু, সৈয়দা যিলু রহমান, সৈয়দা সাথী রহমান
                            │       ├── ৩য় পুত্র: সৈয়দ হাবিবুর রহমান
                            │       │   └── কন্যা: মনোয়ারা বেগম মনি, রানী, ফরিদা, লাকি, চায়না, হাসনা, সোমা, রহিমা, রিমা
                            │       ├── ৪র্থ পুত্র: সৈয়দ মোখলেছুর রহমান
                            │       │   ├── পুত্র: সৈয়দ তাবিবুর রহমান লিটন
                            │       │   └── কন্যা: ঝরনা, তাহমিনা রহমান পান্না
                            │       ├── কন্যা ১: সৈয়দা ফজিলতন নেসা
                            │       │   ├── পুত্র: তাজুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম
                            │       │   └── কন্যা: দুলারী, শেফালী
                            │       ├── কন্যা ২: সৈয়দা জেবুন নেসা জোছনা (স্বামী: ফয়েজ চৌধুরী)
                            │       │   ├── পুত্র: আবিদুর রেজা চৌধুরী রিজভী, আবিদুর মুরছা লিন রিপন, আবদুস সালেহীন শাহিন
                            │       │   └── কন্যা: আফরোজা বেগম রত্না (শাহানা), নাসরিন সুলতানা, তাহমিনা সুলতানা
                            │       └── কন্যা ৪: সৈয়দা নুরুন্নাহার আঙুর
                            │           ├── পুত্র: গালিব, সোয়েব, জাহিদ
                            │           └── কন্যা: পারভীন, শিরিন
                            └── সৈয়দ হানিফ মিয়া
                                ├── পুত্র: চান মিয়া
                                │   ├── পুত্র: মনোয়ার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, সরোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন
                                │   └── কন্যা: রিমী
                                └── কন্যা: ননী (স্বামী: ময়েজ উকিল)
                                    ├── পুত্র: আব্দুর রউফ ডিপটি, শামসুল হক আবু
                                    └── কন্যা: ফিরুজা বেগ

 

By Ekramul hoq

I am A.K.M Ekramul hoq MA.LLB. Rtd Bank Manager & PO of Agrani Bank Ltd. I am interested writing and reading. Lives in Bangladesh, District Jamalpur.

One reply on “জোনাকির আলো জ্বলে”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *