অতীত জীবনের গল্প
সংকলক: এ,কে,এম একরামুল হক
একদিনের গল্প, আজ ইতিহাস হয়ে আছে।
১৯৬০ সালের এক সন্ধ্যায়, রংপুরের আকাশের নিচে, দুটি ভাই-বোন—এফতেদা বেগম রুবী ও আতাউর রহমান মিন্টু—এক অদ্ভুত প্রতিজ্ঞায় বাঁধা পড়লেন। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার টানেই তারা ওয়াদা করলেন, “যার আগে ছেলে হবে, আরেকজনের যদি কন্যা হয়, তবে তাদের পরস্পরকে বিয়ে দেবো।” সেই সময়ের সরলতা আর আত্মীয়তার বাঁধনে এমন প্রতিশ্রুতি ছিল অটুট।
বছর গড়াল।
৯ মার্চ ১৯৬০ সালে রুবীর কোল আলো করে জন্ম নিলো এক পুত্রসন্তান—নাম রাখা হলো রুবেল। আবার ১২ এপ্রিল ১৯৬৬ সালে মিন্টুর ঘরে জন্ম নিলো এক কন্যা—আফরোজা বেগম মমী। দুই পরিবারে দুই শিশু বড় হতে লাগলো, আলাদা শহরে, আলাদা আকাশের নিচে।
সময় বহমান নদীর মতো এগিয়ে গেল।
রুবেল হয়ে উঠলো এক মেধাবী ছাত্র। ১৯৭৭ সালে এইচ.এস.সি পাস করলো জামালপুর সরকারি কলেজ থেকে। আর তখনও মমী রংপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়সের ফারাক থাকলেও, পুরনো প্রতিশ্রুতির ছায়া ভাসছিল দুই পরিবারের হৃদয়ে।
রুবেলের মা রুবী চাইতেন, ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হোক, ডাক্তার হোক, আর ভাই মিন্টুর সঙ্গে করা পুরনো ওয়াদা পূর্ণ হোক। তাই তিনি পুত্র রুবেলকে পাঠালেন রংপুর মেডিকেল কলেজে। সেখানেই তখন রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করছিলেন মামা মিন্টু মিয়া। ভাগ্যের ইশারায় রুবেল ভর্তি হলো ১৯৭৭ সালের ব্যাচে।
মামা-মামীর স্নেহ আর আশ্রয়ে রুবেল সুখের দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু সুখ তো কেবলই ক্ষণস্থায়ী—হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার জীবনে।
রুবেল তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঠিক সেই সময়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ আর কারমাইকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতির আগুন জ্বলছিলো। ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্র শিবিরের সংঘর্ষের মধ্যেই ঘটে গেলো এক ভয়াবহ ঘটনা—কারমাইকেলের ছাত্ররা রংপুর মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র চপলকে হত্যা করে। আর চপল ছিল রুবেলের রুমমেট, একই হলে, একই ঘরে থাকতো।
হত্যা মামলার কালো ছায়া এসে পড়লো রুবেলের জীবনে। নির্দোষ হয়েও নাম জড়িয়ে গেলো মামলায়।
মিন্টু মিয়া দিশেহারা। বোনকে কী বলবেন তিনি?
তখন পরামর্শ এলো রংপুর সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র উকিল এডভোকেট সর্দার এম.এ সাত্তারের কাছ থেকে। তার পরামর্শে প্রমাণ সাজানো হলো—“হত্যার তিন মাস আগেই রুবেলকে অনুপস্থিতির কারণে শো-কজ নোটিশে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।” কাগজপত্র শক্ত করা হলো, আর সে প্রমাণের জোরে রুবেল বেঁচে গেলো হত্যা মামলার কালো ফাঁস থেকে।
কিন্তু সেই মুক্তিই ছিল আরেক নতুন কারাবাস—
চিরকালের জন্য রুবেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
এরপর ধীরে ধীরে মিন্টু মিয়ার মন থেকেও মমী-রুবেলের বিয়ের ওয়াদার কথা হারিয়ে যেতে লাগলো। আর রুবেল ও মমীও, মামাতো-ফুফাতো ভাইবোনের মতো কাটাতে লাগলো দিন।
যেদিন তাদের কানে পৌঁছালো পুরোনো সেই প্রতিশ্রুতির গল্প, তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলো—
“আমরা ভাইবোনই থাকবো, সারাজীবন।”
কারণ মমী জানতো, রুবেলের হৃদয় অন্য কারো জন্য ধুকপুক করছে।
সে হলো গাইবান্ধার তনু ফুফুর মেয়ে—ইভা।
ইভা তখনো ছোট্ট, ক্লাস ফাইভে পড়ে। কিন্তু তার রূপ-লাবণ্য, ফুটফুটে হাসি, শিশুসুলভ ভঙ্গি রুবেলের হৃদয় দখল করে নিয়েছিলো অনেক আগে থেকেই। রুবেল প্রায়ই মমীকে ইভার গল্প শোনাতো, প্রশংসা করতো নিরন্তর। মমীও ইভাকে পছন্দ করতো, যেন আকাশে ঝলমলে তারা।
এইভাবেই, প্রতিশ্রুতি, সংগ্রাম, ভাঙা স্বপ্ন আর এক অদৃশ্য টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলো রুবেলের জীবনযাত্রা…
⛔ চলমান দ্বিতীয় অংশ
রুবেল-ইভার সম্পর্ক, জীবনের বাঁকবদল, এবং সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অগ্নিপরীক্ষা
ইভা—গাইবান্ধার তনু খালার মেয়ে। ছোট বেলায় রুবেলের চোখে সে ছিল এক অদ্ভুত জ্যোৎস্না, নিষ্পাপ, লাজুক অথচ আকর্ষণীয়। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ফুটফুটে মেয়ে ইভাকে দেখলেই রুবেলের মন ভরে যেত। হয়তো তখন প্রেমের সংজ্ঞা বোঝেনি সে, কিন্তু হৃদয় গোপনে ইভার নামেই তাল মিলিয়ে বেজে উঠতো।
মমী সব বুঝতো। ইভা যখনই তাদের আলোচনায় আসতো, রুবেলের চোখে এক ধরনের আলো ঝলক দিতো। কিন্তু সে গোপন ভালোবাসা কারো সামনে কখনও ফাঁস হয়নি। এমনকি ইভাও কিছু বুঝতে পারেনি।
বছরের পর বছর কেটে গেলো।
রুবেল তখন রংপুর মেডিকেল কলেজের স্বপ্ন ভেঙে অন্যপথে এগোচ্ছে। ভর্তি হলো পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। নতুন স্বপ্ন, নতুন লড়াই, নতুন গন্তব্য।
কিন্তু ভাগ্যের অদ্ভুত খেলা—
যাকে হৃদয়ে সযত্নে লালন করেছিলো, সেই ইভাকে হঠাৎ তুলে দেওয়া হলো অন্য কারো হাতে।
ইভার বিয়ে হলো এক ধনাঢ্য টেলিফোন বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।
যিনি বয়সে প্রায় বিশ বছরের বড়, কালো রঙের, মুখাবয়বে কোনো আকর্ষণ নেই। তবুও তনু খালা সম্পদ আর উচ্চপদস্থ চাকরির মোহে মেয়েকে সপে দিলেন তার হাতে।
গাইবান্ধা গার্লস স্কুলের পাশে বিশাল প্রাসাদের মতো বাসা, চাকচিক্যময় জীবনের লোভই ছিল মূল টান। পরিবারের অনেকেই এই বিয়েতে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলো, কিন্তু তনু খালার সিদ্ধান্ত অটল ছিল।
রুবেল তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
অর্থহীন, ক্ষমতাহীন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ভালোবাসার কথা মুখে আনার মতো পরিবেশ তার ছিল না। প্রতিবাদ করার সাহসও জন্মায়নি।
সে শুধু দূর থেকে দেখলো—
তার শৈশবের ভালোবাসা, হৃদয়ের অজানা কষ্টের নায়িকা, অন্যের ঘরে পা রাখছে।
বিয়ের দিন রুবেল একা এক কোণে বসে ছিল।
কেউ জানলো না তার বুকভাঙা আর্তনাদ। শুধু মমী আঁচ করেছিল, কেন রুবেলের চোখে সেই অদ্ভুত অশ্রুজল।
এরপর থেকে ইভা হয়ে গেলো তার জীবনের চিরন্তন অপুর্ণতার প্রতীক।
সারাটা জীবন সেই ব্যথা বয়ে বেড়াতে হলো তাকে।
যে স্বপ্নকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল, তা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো এক ঝটকায়।
প্রেমের কথা কখনও প্রকাশ করা হয়নি,
প্রতিরোধও করা হয়নি,শুধু অন্তরালের এক ব্যথা হয়ে রইলো চিরকাল—
যে ব্যথা একদিন রুবেলকে বদলে দিলো ভেতরে ভেতরে।
⛔
চলমান তৃতীয় অংশ
রংপুর শহরের নীরব বিকেলগুলোতে, মাঝে মাঝে এক চিলতে হাওয়া ভেসে আসতো এডভোকেট এম.এ সাত্তার সাহেবের বাড়ি থেকে। তিনি ছিলেন শহরের সুনামধন্য উকিল, সমাজে সম্মানিত মানুষ। চার কন্যার জনক।
সবার ছোট কন্যা—ওয়াজিফা রহমান বেলী—ছিলো প্রাণোচ্ছল, সরল আর হাসিখুশি এক কিশোরী। তখনো সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী, রংপুর শালবন গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করতো।
সাত্তার সাহেবের বাসার উঠোনে সন্ধ্যা নামতেই খেলা জমে উঠতো। ব্যাডমিন্টন খেলার আসরে হঠাৎ একদিন রুবেলের চোখে পড়লো বেলীকে।
সেই মুহূর্তে মনে হলো, অন্ধকার রাতের মধ্যে হঠাৎ কেউ যেন আলো জ্বেলে দিয়েছে।
দেখা হলো।
চোখাচোখি হলো।
তারপর আলাপ জমলো।
এভাবেই শুরু হলো পরিচয়ের প্রথম ধাপ।
সময় যত গড়ালো, সেই আলাপ পরিণত হলো মধুর সখ্যে, সখ্য পরিণত হলো অদৃশ্য এক টানে।
রুবেল আগেই শিখেছিল, ভালোবাসা কখনো প্রকাশের সুযোগ না-ও পেতে পারে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো।
বেলীর সরল হাসি, অকৃত্রিম মায়া, আর শিশুসুলভ অভিমান রুবেলের ভেতরে নতুন করে বাঁচার আগুন জ্বালালো।
ভালো লাগা গোপনে ভালোবাসায় রূপ নিলো।
আর সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে পরিচয়ের সোনালি অধ্যায়ে পৌঁছালো।
কিন্তু প্রেমের পথ তো কখনোই মসৃণ হয় না।
বাধা এলো এখানেও।
বেলীর বড় দুলাভাই—রংপুরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী, “এস.এ. আরব এন্ড ব্রাদার্স”-এর মালিক—তিনি ছিলেন কঠোর, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মানুষ।
তার চোখে এই সম্পর্ক ছিলো অবাঞ্ছিত।
তিনি জানতেন, তার পরিবারের মর্যাদা, ব্যবসার ঐতিহ্য আর সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ছোট শালীর বিয়ে হতে হবে সমপদস্থ, ধনী ও ক্ষমতাশালী কোনো পরিবারে।
তাই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন রুবেল ও বেলীর ভালোবাসার বিরুদ্ধে এক অটল প্রাচীর হয়ে।
রুবেল আবারও দাঁড়ালো সেই চিরচেনা অগ্নিপরীক্ষার সামনে।
একবার ইভাকে হারিয়ে ছিলো, এবার হারানোর শঙ্কা আরও গভীর হলো।
তবুও, বেলীর সাথে কাটানো দিনগুলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে রইলো।
স্কুলফেরত কিশোরীর সরল হাসি, উঠোনে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট ঘোরানো, ছায়াঘেরা সন্ধ্যার গল্প—সবই একদিন হয়ে উঠলো তার হৃদয়ের অমূল্য সম্পদ।
ভালোবাসা টিকে ছিলো, কিন্তু সামাজিক বাধা ভেঙে বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের শাসন মেনে নিলো রুবেল।
সমাপ্তি : বিদায় স্মৃতিময় রংপুর।
এডভোকেট সর্দার এম এ সাত্তার।
রংপুর শহর—
যেখানে শৈশব থেকে যৌবন, স্বপ্ন থেকে ব্যর্থতা, ভালোবাসা থেকে বেদনার সবকিছু একসাথে মিলেমিশে আছে।
যেখানে মমীর সাথে ভাইবোনের মতো দিন কাটানো, ইভার প্রতি নীরব আকর্ষণ, আর বেলীর সাথে প্রথম সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ—সবই গাঁথা হয়ে আছে।
রুবেলের জীবনের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি হারানো স্বপ্ন, প্রতিটি সম্পর্ক যেন রংপুরের আকাশে লেখা ইতিহাস।
বিদায় নিলো সে শহর থেকে, কিন্তু বিদায় নিতে পারলো না সেই স্মৃতিগুলো থেকে।
আজও হৃদয়ের গহীনে বাজে এক প্রতিধ্বনি—
“বিদায়, স্মৃতিময় রংপুর…”