Categories
My text

নবীর মনের গোপন

নবীর অন্তরের গোপন কথা: কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক মহান কর্মসূচির প্রকাশঃ

আল্লাহ্ তাআলা এক সময় তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.)-কে এক গভীর সত্য জানিয়ে দিলেন, যা তিনি নিজ অন্তরে গোপন রেখেছিলেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে—

“তুমি অন্তরে যা গোপন করছিলে, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন।” (সূরা আহযাব ৩৩:৩৭)

প্রশ্ন জাগে, নবী (সা.) কী এমন গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করলেন?

তৎকালীন সমাজ ও পালিত পুত্রের কুসংস্কারঃ

তৎকালীন আরব সমাজে পালিত পুত্রদেরকে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদা দেওয়া হতো। এমনকি তারা বিশ্বাস করত, পালিত পুত্রের স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরও তার সঙ্গে বিবাহ করা হারাম। এই বিশ্বাস ইসলাম-পূর্ব যুগের একটি গোঁড়ামি ও কুসংস্কার ছিল, যা আল্লাহ্ ইসলামের মাধ্যমে মুছে দিতে চাইলেন।

আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনাঃ

নবী করীম (সা.)-এর পালিত পুত্র ছিলেন যায়েদ (রা.)। তাঁর ফুফাতো বোন ছিলেন জয়নব বিনতে জাহশ (রা.)। রাসূল (সা.)-ই নিজে উদ্যোগী হয়ে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেন, যদিও পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতা তাদের মধ্যে গড়ে উঠেনি। বিবাহিত জীবন সুখকর না হওয়ায় দাম্পত্য কলহ বাড়তে থাকে।

আল্লাহ চাইলেন, এই ব্যর্থ বিবাহের মধ্য দিয়ে একটি ঐতিহাসিক কুসংস্কার চিরতরে নির্মূল করে দেওয়া হোক। কারণ, ভবিষ্যতে আর কোনো নবী আসবেন না। তাই এই বিধানটির বাস্তব প্রয়োগ হতে হবে রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমেই।

নবীর মানবিক সংকোচঃ

আল্লাহ্ নবীকে জানিয়ে দেন, যায়েদ (রা.) যদি জয়নব (রা.)-কে তালাক দেন, তবে আল্লাহ নিজেই তাঁকে নবী করীম (সা.)-এর স্ত্রী করবেন। কিন্তু সমাজের প্রচলিত ধারণা ও মানুষের কটু কথার আশঙ্কায় নবী (সা.) সংকোচ বোধ করেন। তিনি চাচ্ছিলেন, বিষয়টি এমনভাবে ঘটুক যাতে কাউকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়।

যখন যায়েদ (রা.) তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন:

“তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো।”(সূরা আহযাব ৩৩:৩৭)

আসলে নবী (সা.) মানুষ হিসেবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ভয় করছিলেন, যাতে কেউ তার প্রতি কটূক্তি না করে। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন—

“তুমি মানুষকে ভয় করছ অথচ আল্লাহই অধিক হকদার যে তুমি তাঁকেই ভয় করো।” (৩৩:৩৭)

নবীর গোপন ভাবনা কী ছিল?

অনেক হাদীস বিশ্লেষক এই “গোপন রাখার” বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা মনে করেছেন, নবী (সা.) জয়নব (রা.)-এর রূপে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেই আকর্ষণই গোপন রেখেছিলেন। এটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অনুমানভিত্তিক ধারণা, যা এক মহান রাসূলের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করে।

আসল ঘটনা হলো:
নবী (সা.) তাঁর আপন সুন্দরী ফুফাতো বোনকে তাঁর পালিত পুত্রের সঙ্গে নিজে বিয়ে দিয়ে ছিলেন। সেই বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজ কী বলবে—এই প্রশ্নই তাঁকে অন্তরে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি ভাবছিলেন:

“আমি তো নিজেই এই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি, এখন যদি তা ভেঙে যায়, সমাজ কি আমাকে সত্য নবী মনে করবে? আমি কিভাবে জবাব দিবো?”

এই সংকোচ, এই মানবিক দুশ্চিন্তা ছিল তাঁর গোপন বিষয়। আর সেই অন্তরের ভাবনাকেই আল্লাহ প্রকাশ করে দেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে—নবীও একজন মানুষ, কিন্তু তিনি আল্লাহর নির্দেশে দিধাহীনভাবে অগ্রসর হন।

কুসংস্কারের অবসান :
অবশেষে, যায়েদ (রা.) তালাক দেন এবং আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন:

“অতঃপর যায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে পালিত পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে…”(সূরা আহযাব ৩৩:৩৭)

এই আয়াত শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনার নয়, বরং এক যুগান্তকারী সমাজ সংস্কারের নিদর্শন। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ ইসলামের সুশৃঙ্খল বিধান কায়েম করলেন এবং একটি বহুল প্রচলিত কুসংস্কার মুছে দিলেন।

وَتُخْفِي = আর তুমি গোপন করেছিলে

, فِي نَفْسِكَ = তোমার মনের মধ্যে,

مَا اللَّهُ = আল্লাহ যা

, مُبْدِيهِ = প্রকাশ করতে চান

Verified by ExactMetrics