পশু কুরবানী, হজ্ব সম্পর্কে, কুরআন থেকেঃ
*****************************
আমরা জানি, মানব জাতির জন্য আদিতে যে গৃহটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উহা বাক্কায় অর্থাৎ মক্কায় অবস্থিত। যখন ইব্রাহিম আঃ বলেছিলেনঃ “হে প্রভু ইহাকে তুমি নিরাপদ শহর করিও এবং ইহার অধিবাসীদের মধ্য হইতে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান আনে তাদেরকে জীবিকা প্রদান করিও। “(২ঃ১২৬)
এখানে উল্লেখ্য যে,মুসলিমদের সকল আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো এই কাবাঘর কেন্দ্রীক। এই জন্য আল্লাহ বলেন, মক্কা ও তার চর্তুপার্শের লোকদেরকে সতর্ক কর তারা যেন সালাত হেফাজত করে (৬ঃ৯২)।
ঠিক একই ভাবে কুরবানীটাও মক্কা শহর কেন্দ্রীক। আদম আঃ এর দুই সন্তানের প্রতি কুরবানীর হুকুম হয়েছিল মায়েদা ৫ঃ২৭। এই আয়াতে কুরবানীর আরবী শব্দ এসেছে قُربانًا আর এই কুরবানী শব্দের অর্থ হচ্ছে যার সাহায্যে প্রভুর সান্নিধ্য লাভ হয়।
আর ইব্রাহিম (আঃ) ও এই কুরবানীর মাধ্যমেই মুক্ত হয়েছিল(৩৭ঃ১০৭)। এই আয়াতে আরবী بِذِبحٍ শব্দ এসেছে। জবেহ অর্থ গলা কাটা। কারণ আদম আঃ ও ইব্রাহিম আঃ উভয়ই মক্কার অধিবাসী ছিলেন। বিধায় প্রমাণিত হয় যে, কুরবানীর বিষয়টাও মক্কা শহর কেন্দ্রিক। তারপরও এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা কুরবানী কর,প্রাচীন গৃহের সীমানার ভিতর (২২ঃ৩৩)। এ আয়াতে আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে مَنسَكًا । প্রাচীন গৃহ বলতে কাবা ঘরকে বুঝানো হয়েছে।
কুরবানীর স্থান হিসাবে প্রাচীন গৃহ কাবা ঘরই একমাত্র ঠিকানা। আর তাই হজ্বের সাথে কুরবানীর সম্পর্ক। হজ্বের জন্য একমাত্র কাবা ঘরই নির্দিষ্ট স্থান(৩ঃ৯৭)। এইজন্য হজ্ব যখন, কুরবানীও তখন। আর তাই হজ্ব যেখানে, কুরবানী ও সেখানে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা হজ্ব ও ওমরাহ পালন কর (২ঃ১৯৬)।
এখানে কোরবানীর আরবী শব্দ প্রয়োগ হয়েছে الهَدىُ । যার অর্থ নির্দেশিকা বা গাইডলাইন।
মক্কা বিজয়ের সময় কাফিররা হজ্ব যাত্রীদেরকে কাবায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল (৪৮ঃ২৫)। আর তখনই আল্লাহ ঘোষণা দিলেন, তোমরা যেখানে বাধাগ্রস্থ হও, সেখানেই কুরবানী দাও (২ঃ১৯৬)। ব্যবহৃত আরবী শব্দ الهَدىُ ।
কারণ কুরবানীর মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌছে না,বরং পৌছে তাকওয়া(২২ঃ৩৭)। তাকওয়া মানে খোদা ভীতি। এখানে উল্লেখ্য যে, কোন ধরণের পশু কুরবানী দেওয়া যায়েজ এটা আমাদের জানা উচিত। যে সকল পশু হারাম করা হয়েছে এবং যে সকল পশু হালাল অথচ চর্বী হারাম করা হয়েছে, সে সকল পশু কুরবানী না দেওয়াই উত্তম। এই মর্মে আল্লাহ বলেন নখরযুক্ত পশু হারাম এবং গরু ও ছাগলের এক ধরনের চর্বিও হারাম ৬ঃ১৪৬। তাহলে দেখা গেল গরু ও ছাগলের দেহে হারাম চর্বী থাকায় গরু ও ছাোগল কুরবানি না দেওয়াই উত্তম। হলুদ বর্ণের উজ্জল গাভীকে কুরবানি দিতে বলা হয়েছে ২ঃ৬৯। এখানে অন্য কোন পশুর কথা বলা হয়নি।
অতঃপর উহাদের কুরবানীর স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট। (২২ঃ৩৩)
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে প্রমাণিত হয় যে, হজ্বের সাথে কুরবানীর সম্পর্ক। আর কুরবানীর জন্য একমাত্র ঠিকানা হচ্ছে কাবা ঘর। এখানে উল্লেখ্য যে,তাই যারা কাবাঘরের সীমারেখার বাইরেও কুরবানীর প্রথাকে চালু রেখেছে তাদের কুরবানী কুরআন ভিত্তিক নহে এটা নিশ্চিত।
পৃথিবীর শুরু থেকেই কোরবানী প্রথা ছিল। শুধু ইব্রাহীলম আঃ এর সময় থেকেই নয়। আদম আঃ দূই পুত্র আলাদা আলাদা কোরবানী করলেন। একজনের টা কবুল হলো অন্য জনেরটা কবুল হল না। তখন এক ভাই অপরেকে হত্যা করতে চাইল।
” আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাহাদেরকে যথাযথ ভাবে শোনাও। যখন তাহারা উভয়ে কুরবানী করিয়াছিল তখন একজনের কুরবানী কবূল হইল এবং অন্য জনের কবূল হইল না। সে বলিল, ‘আমি তোমাকে হত্যা করিবই।’ অপরজন বলিল, ‘আল্লাহ্ তো একমাত্র মুত্তাকীদের কুরবানী কবূল করেন।’ (৫ঃ২৭)”
এ থেকে প্রমাণিত প্রচলিত ভাগে দেয়া কোরবানী কোন ক্রমেই সঠিক নয়। হাদীসও এটি সমর্থন করে নি। একটি হাদীস আছে যেখানে সফর রত অবস্থায় প্রবাস কালীন সময়ে কয়েকজন সাহাবী ভাগে কোরবানী দিয়েছিলেন। পরবর্তি সময়ে তাহারা আর অনুরুপটি পুনারাবৃতি করেন নি।
কুরবানী আল্লাহ সবার জন্য বিধান দিয়েছেন
(২২ঃ৩৪) আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযক্ দেয়া হয়েছে সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, (এই বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কিন্তু এক- আল্লাহর নির্দেশ পালন কারণ তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য,কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদেরকে।
অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি দাও।(১০৮ঃ২)।
কোরবানীর পশুর গলায় মালা দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।
হে মু’মিনগণ! আল্লাহ্র নিদর্শনের, পবিত্র মাসের, কুরবানীর জন্য কা’বায় প্রেরিত পশুর, গলায় পরান চিহ্নবিশিষ্ট পশুর এবং নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তোষ লাভের আশায় পবিত্র গৃহ অভিমুখে যাত্রীদের পবিত্রতার অবমাননা করিবে না। যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হইবে তখন শিকার করিতে পার। তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালংঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও তাক্ওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা করিবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহ্কে ভয় করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর। (৫ঃ২)
পবিত্র কাবাগৃহ, পবিত্র মাস, কুরবানীর জন্য কাবায় প্রেরিত পশু ও গলায় মালা পরিহিত পশুকে আল্লাহ্ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করিয়াছেন। ইহা এইহেতু যে, তোমরা যেন জানিতে পার-যাহা কিছু আসমান ও যমীনে আছে আল্লাহ্ তাহা জানেন এবং আল্লাহ্ তো সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। (৫ঃ৯৭)
কোরবানীর পশুর গলায় মালা দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।
হে মু’মিনগণ! আল্লাহ্র নিদর্শনের, পবিত্র মাসের, কুরবানীর জন্য কা’বায় প্রেরিত পশুর, গলায় পরান চিহ্নবিশিষ্ট পশুর এবং নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তোষ লাভের আশায় পবিত্র গৃহ অভিমুখে যাত্রীদের পবিত্রতার অবমাননা করিবে না। যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হইবে তখন শিকার করিতে পার। তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালংঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও তাক্ওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা করিবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহ্কে ভয় করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর। (৫ঃ২)
পবিত্র কাবাগৃহ, পবিত্র মাস, কুরবানীর জন্য কাবায় প্রেরিত পশু ও গলায় মালা পরিহিত পশুকে আল্লাহ্ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করিয়াছেন। ইহা এইহেতু যে, তোমরা যেন জানিতে পার-যাহা কিছু আসমান ও যমীনে আছে আল্লাহ্ তাহা জানেন এবং আল্লাহ্ তো সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। (৫ঃ৯৭)
যদিও ৫ঃ২/৯৭ আয়াতে কুরবানির পশুর গলায় মালা দেয়ার কথা বলা হয়েছে এবং মালা না দিলে কুরবানি হয়না বলা হয়েছে তবুও এটি একটি রুপক কথা । মানব দেহের অভ্যন্তরস্থ প্রতিটি পশুকে মনের ভাষায় নামকরণ করে চিহ্নিত করাকে এবং বশ করাকে পশুর গলায় মালা পরানো বুঝায়িছেন।
যেমনঃ কুরআন বলেছে, ” তোমরা একটি হলুদ রঙ্গের বাকারা বা গাভী জবেহ করো ২ঃ৬৭ । হলুদ রঙ্গের বাকারা তথা গাভী শব্দটি ও একটি রুপক শব্দ । শিষ্য দিগকে কেহ বলেছেন মেষ, তাই নবী হলেন মেষ পালক, কেহ বলেছেন ধেনু, কেহ বলেছেন বাকারা ইত্যাদি ।
রুপকের সঠিক মুলক বা উপমার উপমান গ্রহণ না করে স্থুলতাকে গ্রহণ করবার প্রবণতা বস্তুবাদী ধার্মিকগণের মধ্যে বা সাম্প্রদায়িক ধার্মিকগণের মধ্যে প্রবল ।
পশুকে প্রতীক করে উহার উপর অন্তরের পশুকে উৎসর্গ করবার জন্যই আনুষ্ঠানিক পশু জবেহের প্রয়োজন।
যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে আনুষ্ঠানিক পশু জবেহ তাঁদের জন্য ওয়াজেব করা হয়েছে ।
কিন্তু কোনরূপ ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি না করে যদি কেহ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক পশু জবেহ করেন তবে উহা একটি জীব হত্যা ব্যতীত কিছুই নয়।
পশুর রক্ত দেখে, মাংশ খেয়ে নিজেদের মধ্যে লুকায়িত সুপ্ত পশু সত্বা বা পশুবৃত্তি গুলি কে বরং উজ্জিবিত করা হয়। মনের পশুত্ব শক্তিকে উস্কে দেয়া হয়।
কুরবানী শব্দটি ৫ঃ২৭ আয়াতে উল্লেখ পাওয়া যায়। যার অর্থ হচ্ছে উৎসর্গ করা। এর সমার্থক শব্দ হিসেবে জবেহ শব্দটি কয়েকটি স্থানে উল্লেখ রয়েছে। যার অর্থ করা হয়েছে জবাই। হাকিকতের কুরবানি হচ্ছে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুবৃত্তি সত্বাকে সরিয়ে দেয়া, কতল করা বা ত্যাগ করা । তাই ২ঃ৬৯ আয়াতে উজ্জল হলুদ গাভী জবেহ করতে বলা হয়েছে। এই হলুদ গাভী নামে কোন প্রানী জীবজগতে নাই। বিধায় শব্দটি রুপক। ঐ দিকে ২ঃ৫৪/ ৪ঃ৭৬ আয়াতে নফসের কুপ্রবৃত্তিকে হত্যা বা কতল করতে বলা হয়েছে।
” অর্থাৎ তোমাদের নফসের কুরবানি (কতল) করা ইহা তোমদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাক” ২ঃ৫৪/ ৪ঃ৭৬ ।
তাই তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন,
মনের পশুরে করিলে জবাই
পশুরাও বাঁচে বাঁচিবে সবাই।
সবশেষে বলবোঃ
১) ভাগে কোরবানীর কোন বিধান আল্লাহ দেন নি।
২) কোরবানী প্রতিটি নর নারীর জন্য পৃথক বিধান।
৩) যার সামর্থ নেই তার পক্ষ থেকে কোন করবানী নেই।
৪) কোরবানী হজ্জের সাথেই সংশ্লীষ্ট। কাবার এলাকায় যাদের বসত নয় তাদের জন্য কোরবানী দেয়ার সামর্থ না থাকলে হজ্জের দিন গুলিতে তিন দিন এবং বাড়ী ফিরে ৭দিন মোট ১০ দিন রোজা পালন করার নির্দেশ।(২ঃ১৯৬)
৫) কোরবানীর মাংস তিনভাগা এমন কোন নীতি নেই। নিজে খাবে এবং অন্য যাকে যতটুক দিতে মন চায় বিলাবে।
৬) কোরবানীর চামড়া নিজে ব্যবহার করলেও কিছু সমস্যা নেই, উত্তম সদকা করে দেয়া। যেখানে মাংস একা খেলে কোন অসুবিধে নেই। তবে মজুদ করা যাবে না পাশে যদি কেহ অভুক্ত থাকে।
৬) হজ্জ ব্যতীতও স্বস্ব জায়গায় কোরবানী প্রদানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
সবশেষে বলা যায় হজ্জের অনুষ্ঠান ছাড়া আমাদের মনে জাগা প্রচলিত কোরবানী হলঃ
“আনুষ্ঠানিক পশু জবেহের প্রয়োজনীয়তা এতটুকুই যে, উহা না রাখলে অনুষ্ঠান ধর্ম জনমনে দুর্বল হয়ে যায় ।”
দ্রষ্টব্যঃ কোন দ্বীমত বা অধিক কিছু জানা থাকলে রেফারেন্স সহ জানিয়ে পরিশুদ্ধ হতে সাহায্য করবেন।