দীর্ঘদিন যদি কোন মিথ্যে শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে যায় এবং তার বিপরীত কোন সত্য হাজির না হয়, তবে সে মিথ্যেটাও একদিন সত্যে পরিনত হয় এবং তা মানব হৃদয়ে মজবুদ এক ভিত গেড়ে বসে। সে তখন সে ভিত থেকে আর সড়ে আসতে পারে না, যত সত্যই তার কাছে উপস্থাপন করা হোক না কেন। এবং এই বিশ্বাসের ঘরে কেউ আঘাত করলে তা মেনে নিতে পারে না। এমনকি নিজ সন্তানকেও সে ত্যাগ করতে প্রস্তুত। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া পড়শি, আত্মীয়- স্বজন তো দুরে থাক। তার মনে দীর্ঘ দিনের লালিত সে বিশ্বাসের বিপরীতে কোন সত্যকেও উপস্থাপন করা হলে সে আঁৎকে উঠে। প্রতিহত করতে চায়, বিরোধিতায় লিপ্ত হয় এমন কি জীবন জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। আর যদি সে বিশ্বাস হয় ধর্মীয় – তবে তো আর কথাই নেই। ফলে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরও দেখা যায় একটি মানুষ তার গোড়ামীর প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার মুল কারন সত্যটা তার সামনে শুরুতে কোন দিন উপস্থাপন করা হয়নি। এ কারনে পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে জাতী একটি হলেও ধর্ম চার হাজারের অধিক। কেউ কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত থেকে এক বিন্দু টলাতে সক্ষম নয়। কারন জন্মগত ভাবে সে এ অনুভুতি গুলো দেখে আসতেছে। বহু পুর্ব হতে বাপ-দাদাদেকেও এরুপই করতে দেখে এসেছে। সে যাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে যাকে ইত্তেবা করে তার মুখেও এমনি শুনে এসেছে। তাই তার অন্য কোন নতুন কথা, মতবাদ কানে পৌছা মাত্র গা জ্বলে উঠে। তা শোনা তা একটু রিভিউ করে দেখা তো দূরে থাক।
যার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ নবী-রাসুল, পথ প্রদর্শক, জ্ঞান বিজ্ঞানে সামৃদ্ধ বহু মনষীদের পৃথিবীর বুকে প্রেরন করেছেন এবং সাথে দিয়েছেন ঐশী গ্রন্থ। পাশাপাশি পাঠিয়েছেন মানুষকে সভ্যতার ক্রম বিকাশের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান ভান্ডারের কিছু মানুষ। যারা সভ্যতা সাংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলে পৃথিবীকে সুন্দর বসবাস উপোযোগী করে তুলতে সহায়ক হয়েছেন। প্রযুক্তি যেমন যুগের চাহীদায় ক্রম পরিবর্তন হয়ে আসছে, মহান আল্লাহও বিভিন্ন ঐশী গ্রন্থগুলির তেমনে মুলনীতি অপরবর্তনীয় রেখে যুগ ও সময়ের চাহীদায় সর্বশেষ সংস্কারকৃত এবং পুর্ণাঙ্গ ঐশী গ্রন্থ আল কোরআনকে উপহার দিয়ে মানবের জীবন বিধানের গাইড লাইন দিয়ে দিয়েছেন এবং এটাই শেয ও চুড়ান্ত বলে ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন পুর্ববর্তি তোমাদের কাছে যা কিছুই থাকুক না কেন এ কোরান পৌছার পর এটিই চুড়ান্ত ও সর্বশেষ এটির বাহককে সহ এই কিতাবের ইত্তেবা করতে যে কিনা তোমাদের কাছে ইতিপুর্বে যা দেয়া হয়েছে তারও সত্যায়ন করতে সক্ষম। সূরা ইমরান, আয়াত ৮১…..
স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার লইয়াছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যাহা কিছু দিয়াছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যাহা আছে তাহার প্রত্যায়ন কারীরূপে যখন একজন রাসূল আসিবে তখন তোমরা অবশ্যই তাহার প্রতি ঈমান আনিবে এবং তাহাকে সাহায্য করিবে। তিনি বলিবেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করিলে ? এবং এই সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করিলে ?’ তাহারা বলিল, ‘আমরা স্বীকার করিলাম।’ তিনি বলিলেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রহিলাম। (সূরা ইমরান আয়াত ৮১)
মানুষের জন্মগত ভাবে পোষনকৃত এই পুর্ববর্তি ধর্মীয় অনুভুতি সত্য – না মিথ্যে তা যাচাই করে বিশ্বাসের পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য এই কোরানই একমাত্র উপদেশ গ্রন্থ। তাই এই কোরানের প্রতি যার পরিপুর্ণ ঈমান রয়েছে সেই একমাত্র সৌভাগের সরল পথ ও বিশ্বাসের সন্ধান পাবে।
এ আলোচনার মুল প্রতিপাদ্য আমি আমার ধর্মীয় অনুভুতি, এবাদত বন্দেগী এবং আমার জীবন ব্যবস্থাকে কোরানের আলোকে যাচাই বাছাই করে নিয়ে পরিপালন করবো, এর বাহিরে যা তা আমার জীবন বিধান হিসেবে পরিত্যাজ্য। অবশিষ্ট যেসকল গ্রন্থ —- হতে পারে তা আমার শিক্ষা-সাংস্কৃতি,জ্ঞান বিজ্ঞানের সহায়ক হিসেবে গ্রহনীয় কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান হিসাবে প্রয়োগের জন্য নয়। এ বিষয়ে দ্বীমত থাকলে তবে পরবর্তি আলোচনায় না যাওয়ার অনুরোধ। আমি আমার এ চিন্তা একমাত্র সঠিক এবং তা অন্যকেও অনুসরনের পরামর্শ দেব না। কারন রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট একটি সংবেদনশীল সাবজেক্ট যা অনস্বীকার্য।
রোগ-শোক,বিসন্নতা,ঝড়,জলোচ্ছাস,যুদ্ধ-বিগ্রহ এমন কি মুমুর্ষ অবস্থাতেও নামাজ পড়তে হবে। এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে ৮০ হুগবা দোজখে বাস করতে হবে। এটাই চির সত্য, বদ্ধমুল বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
আল্লাহ কোরানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আয়াত নাযিল করেছেন, যাতে আমাদের প্রধান ইবাদত যা ধনী-গরীব, সুস্থ- অসুস্থ, মৃত্যু পথ যাত্রী সকল মুসলমানের জন্য সর্ব অবস্থায় মানা ফরজ। আসলেই কি আল্লাহ এত কঠোরতা আরোপ করেছেন মানুষের উপর? কোরানের আলোকে যাচাই করে দেখি। আমরা যাকে নামাজ বলে জানি কোরানে তা সালাত শব্দে বর্ণিত। ৮০+ জায়গায় বিভিন্ন ভাবে এ সালাত শব্দটি এসেছে। যা আমরা দৈনিক পাচ ওয়াক্ত পড়তে হয় বলে জানি এবং গুরুত্তে সাথে পড়ে থাকি। প্রকৃত কি এই যে প্রচলিত নামাজ আমরা পড়ি আল্লাহ কোরানে যে সালাত কায়েম করার কথা বলেছেন তা প্রকৃত কি এভাবেই, না অন্য কিছু? কোরানের আলোকে দেখে নেই।
তার আগে সুরা আরাফের একটি আয়াত স্মরন করিয়ে বলবোঃ
যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগের সঙ্গে উহা শ্রবণ করিবে এবং নিশ্চুপ হইয়া থাকিবে, যাহাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়। (৭ঃ২০৪)
অর্থাৎ যখন কোরান থেকে কোন আলোচনা হবে তখন অন্য কোন গ্রন্থ বা কথা দ্বারা রেফারেন্স দেয়া আল্লার সাথে চ্যালেঞ্জ করার সামিল। সেক্ষেত্রে আল্লাহর রহমতের আশা করা যাবে না।
তাই নামাজ সম্বন্ধে যে কোন পুর্ব অনুমানকে, হাদীস, কিয়াস,তাফসীর নামক মানব রচিত যে কোন গ্রন্থকে বোতল বন্দী করে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় বুঝা সম্ভব নয়, দয়াময়ের রহমতেরও আশা করা যায় না। যেহেতু কোরানের আলোচনা শুধু। তবে হ্যা কোন তথ্যে দ্বিমত হলে তা কোরানের আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে বা গ্রামিটিক্যালল উপাত্ত উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আরবী সলাহ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু ফলো করা, বা মুখোমুখি সংযোগ স্থাপন করা এবং মুছাল্লী অর্থ ছায়ার মত অনুসরন করা, নামাজ নয়। এ বাংলা শব্দ কি ভাবে চয়ন করা হল তা ব্যাখায় জানানো হবে।
আকিমুস সলাত মানে কোরানে বর্ণিত আল্লাহর সকল বিধি নিষেধ সর্ব অবস্থায় মেনে নেওয়া,ছায়ার মত লেগে থাকা। যা অনুসরন করা বাধ্যতামুলক। সুরা কিয়ামাহ আয়াত ৩১ ও ৩২ নং লক্ষ্য করলে তা বুঝা যায়।
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلّٰىۙ
وَلٰكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰىۙ
সে বিশ্বাস করে নাই এবং নামাজ আদায় করে নাই। বরং সে মিথ্যে বলেছিল এবং মুখ ফিরাইয়া লইয়াছিল।
এখানে ছল্লা صَلّٰىۙ ( নামাজ) বিপরীত শব্দ تَوَلّٰىۙ তাওয়াল্লা (মুখ ফিরিয়ে নেওয়া) এবং সদ্দকা صَدَّقَ (সত্য) বিপরীত কাজ্জাব كَذَّبَ (মিথ্যা)
তাওয়াল্লা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে ছল্লা এর অর্থ মুখোমুখি হওয়া বা সংযোগ স্থাপন করা বা অনুসরন করা সঠিক। কিন্তু পারশিয়ান শব্দ নামাজ বসিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মর্ম উপলব্ধিতে ব্যহত করা হয়েছে। পুর্ব অনুমানের অনুবাদ থেকে বেরিয়ে এসে যদি সঠিক বাংলা অনুবাদ করা হয় তবে উক্ত আয়াতের অনুবাদ হয়ঃ
সে সত্য বলে না, অনুসরনও করে না। বরং সে মিথ্যে বলে এবং মুখ ফিরেয়ে নেয়।
সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫, এখানে সালাতের অর্থ নামাজ ধরে অনুবাদ করলে এর অর্ঘ দাড়ায় :
” আপনি কোরান পড়ুন এবং নামাজ আদায় করুন। নিশ্চয় নামাজ অনৈতিক ও অন্যায় কাজ হতে ফরাইয়া রাখে। “
কিন্তু নামাজ কি নিশ্চিত অনৈতিক ও অন্যায় কাজ হতে ফিরাইয়া রাখতে সক্ষম হয়? একজন মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে একি সাথে অনৈতিক, অন্যায় কাজের সাথে জড়িত হতে পারে। একমাত্র কোরানের নিরবাচ্ছন্ন অনুসরনই একজন মানুষকে অন্যায়, অনৈতিক কাজ থেকে ফিরায়ে রাখতে পারে। তাহলে বুঝা যায় সালাতের অনুবাদ কখনোই নামাজ নয়। সালাতের অনুবাদ রবের ঐশী কমান্ড ছায়ার মত অনুসরন করা। পুর্ন মেনে চলা।
সুতরাং এ আয়াতের যৌক্তিক অনুবাদ হবেঃ
” আপনি কোরআন পড়ুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। নিশ্চয় কোরনকে নিরবিচ্ছন্ন অনুসরন অন্যায় অনৈতিক কাজ হতে ফিরাইয়া রাখে। “
উক্ত আয়াতে صَّلٰوةَ সালাত শব্দের অর্থ কখনোই নামাজ হতে পারে না। কারন নামাজ কি আসলেই অন্যায় বা অনৈতিক কাজ হতে ফিরিয়ে রাখতে পারে? একজন মানুষ পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আবার অন্যায়, অনৈতিক কাজও করতে পারে। কিন্তু আয়াতে আল্লাহ বলতেছেন, নিশ্চয় সলাত صَّلٰوةَ অন্যায়, অনৈতিক কাজ হতে ফিরিয়ে রাখে। তাহলে কি আয়াত মিথ্যে ? না। আসলে সালাত صَّلٰوةَ এর ফার্সী অনুবাদ পরিহার করে সঠিক বাংলা শব্দ বসালেই আয়াতের মর্ম বোধগম্য হয়ে উঠে। একমাত্র আল্লাহর আদেশের নিরবাচ্ছন্ন অনুসরন অন্যায় ও অনৈতিক কাজ থেকে একজন মানুষকে ফিরায়ে রাখতে সক্ষম। সুতরাং সালাতের صَّلٰوةَ বাংলা অর্থ আল্লাহর আদেশ ছায়ার মত অনুসরন করা,মেনে চলা বা রবের সাথে মুখোমুখি সংযোগ স্থাপন করা।অর্থাৎ আপনি আপনার উপর যে কিতাব প্রেরন করা হয়েছে উহা পড়ুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। নিশ্চয় নিরাবচ্ছন্ন (কোরানের আদেশ) অনুসরন অন্যায় ও অনৈতিক কাজ হতে ফিরায়ে রাখে। সালাতের صَّلٰوةَ অর্থ যদি আল্লাহর সকল আদেশ নিষেধ নিরবচ্ছন মেনে নেয়া বুঝায় তবে নিঃসন্দেহে সালাতই হবে বেহেস্তের চাবী। নামাজ অর্থে বেহেস্তের চাবী হতে পারে না। তাহলে তো কোরানে বাকী আয়াত গুলি অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় গন্য হয়।
উহাদের পরে স্থলাভিষিক্ত হলো পরবর্তীরা, তাহারা সালাত নষ্ট করিল ও লালসা-পরবশ হইল। সুতরাং উহারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করিবে, কিন্তু উহারা নহে-যাহারা তওবা করিয়াছে, ঈমান আনিয়াছে ও সৎকর্ম করিয়াছে। উহারা তো জান্নাতে প্রবেশ করিবে। উহাদের প্রতি কোন জুলুম করা হইবে না। (১৯:৫৯-৬০)
এখানে صَّلٰوةَ মানে রবের কমান্ডা অনুসরন অর্থাৎ কোরানের সকল আদেশ নিরবাচ্ছন্ন অনুসরন অনুবাদ করলে আয়াতের মর্ম সঠিক ভাবে উপলবদ্ধি করা যায়। নচেৎ বুঝাবে আগে নামাজ একরকম ছিল পরে তা কোন দল বা গোষ্ঠি পরিবর্তন করে ফেলেছে।
অনুরুপ সুরা মায়েদা ৫৫ নং আয়াত,তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ্, তাঁহার রাসূল ও মু’মিনগণ-যাহারা বিনত হইয়া সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়।
সূরা বাকারাঃ৪৩ তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যাহারা রুকূ’ করে তাহাদের সঙ্গে রুকূ’ কর। (২:৪৩)
وَاَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ
এখানে রুকু অর্থ নুইয়ে পড়া,ঝুকে পড়া। যার আরেক মিনিং স্বচ্ছল অবস্থা থেকে আর্থিক ভাবে নুয়ে পড়া। এখানে যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে রুকু অবস্থায়। এই রুকু অবস্থায় মানে নামাজে রুক ধরলে সালাতের অর্থ নামাজ নয়। এই আয়াতে বিনীত ভাবে বা আর্থিক ভাবে পতিত অবস্থাতেও যাকাত দিতে বলেছেন। এর পড়ের আয়াতে তা স্পষ্ট।
তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও, আর নিজদেরকে বিস্মৃত হও ? অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তবে কি তোমরা বুঝ না ? (২:৪৪)
اَتَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ اَنْفُسَكُمْ وَاَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْكِتٰبَؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ
‘হে মারইয়াম! তোমার প্রতিপালকের অনুগত হও ও সিজদা কর এবং যাহারা রুকূ’ করে তাহাদের সঙ্গে রুকূ’ কর।’ (সূরা ইমরান, ৪৩)
يٰمَرْيَمُ اقْنُتِىْ لِرَبِّكِ وَاسْجُدِىْ وَارْكَعِىْ مَعَ الرّٰكِعِيْنَ
এখানে সালাতে কোন উল্লেখই নাই। সিজদা রুকু বলতে তাহলে কি বুঝিয়েছেন। সিজদা শব্দের আভিধানিক অর্থ সমর্পন করা একটা সিস্টেমর আনুগত্য করা্। সিজদা শব্দের অনুবাদ সুরা রহমান,আয়ত, ৫ ও ৬ আয়াত লক্ষ্য করলে স্পস্ট হবে।
সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে,
নক্ষত্ররাজী ও বৃক্ষাদি তাঁহারই সিজদায় রত রহিয়াছে,
وَّالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدٰنِ
اَلشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ
সূরা হাজ্জ:
তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ্কে সিজদা করে যাহা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে ? আবার অনেকের প্রতি অবধারিত হইয়াছে শাস্তি। আল্লাহ্ যাহাকে হেয় করেন তাহার সম্মানদাতা কেহই নাই; আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন। সূরা নম্বরঃ ২২, আয়াত নম্বরঃ ১৮
এ আয়াত অনুযায়ী তারকা,গাছপালা, চন্দ্র,সূর্য, পর্বতরাজী, এমন কি জীবজন্তুও আল্লাহকে সিজদা কি ভাবে করে? আল্লাহর প্রদত্ত বিধান মত কার্য সম্পাদনকেই সিজদা বুঝিয়েছে। আল্লাহকে সিজদা করা মানে আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পন করা।
সূরা নাহল ৪৯ ও ৫০ নং আয়াতঃ আল্লাহ্কেই সিজদা করে যাহা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে, পৃথিবীতে যত জীবজন্তু আছে সে সমস্ত এবং ফিরিশতাগণও, উহারা অহংকার করে না।
وَلِلّٰهِ يَسْجُدُ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْاَرْضِ مِنْ دَآبَّةٍ وَّالْمَلٰۤٮِٕكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُوْنَ
পরের ৫০ নং আয়াতে এ সিজদার ব্যাখ্যা এসে যায় অটোমেটেকলি।
উহারা ভয়করে উহাদের উপর উহাদের প্রতিপালককে এবং উহাদেরকে যাহা আদেশ করা হয় উহারা তাহা করে। (১৬ঃ৫০)
يَخَافُوْنَ رَبَّهُمْ مِّنْ فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ
এখানে সিজদা অর্থ বুঝাচ্ছে, তারা তাদের রবকে ভয় করে এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে। মাটিতে কপাল ঠুকিয়ে সিজদাকে বুঝানো হয় নি।
সূরা ফাতাহ,আয়াত নং ২৯
আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাহাদেরকে রুকূ ও সিজদায় অবনত দেখিবে। তাহাদের লক্ষণ তাহাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফুটিত থাকিবে; তওরাতে তাহাদের বর্ণনা এইরূপ এবং ইঞ্জীলেও তাহাদের বর্ণনা এইরূপই। তাদের চেহেরায় সিজদার চিহ্ন থাকে বলতে তাদের চেহারায় বিনয়ের ছাপ থাকে। চেহারায় সিজদার চিহ্ন মানে কপালে কাল দাগ নয়।
সূরা জুমার ৯ নং আতে জুমার সালাতের কথা বলা হয়েছেঃ
হে মু’মিনগণ! জুমু’আর দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহ্র স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, ইহাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর।(৯:৬২)
এখানে জুম্মা সম্মেলন এবং সেটা নির্দিস্ট কোন দিন বুঝায় না। সেটা যে কোন দিন হতে পারে। আর সলাতের অনুবাদ রবের কমান্ড বা কোরানের বিধিনিষেধ অনুসরন করা বসিয়ে দেখুন।
দায়েমী সালাত, মানে সালাত সর্বক্ষন……
যাহারা তাহাদের সালাতে সদা প্রতিষ্ঠিত, (৭০ঃ২৩)
الَّذِيْنَ هُمْ عَلٰى صَلَاتِهِمْ دَآٮِٕمُوْنَ
এত্র আয়াতে সলাত সর্বক্ষন হলে আপনি তাকে পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোন সুযোগ আছে কি? তার মানে সলাত অর্থ নামাজ নয়। সলাত অর্থ রবের সকল কমান্ড অনুসরন করা বসিয়ে দেখুন মর্ম উপলবদ্ধী সহজ হয়ে যাবে।
এবার সূরা মুদ্দাসের এর ৪২ আয়াতের প্রতি খেয়াল করলে ছল্লা মুছু্ল্লীর ধারনা ও অবস্থান বৈশিষ্ট উপলব্ধি সহজ হবে।
‘তোমাদেরকে কিসে সাকার-এ নিক্ষেপ করিয়াছে?’৭৪:৪২
مَا سَلَـكَكُمْ فِىْ سَقَرَ
এর পরের আয়াতে জাহান্নামীরা উত্তরে বলিবে:
উহারা বলিবে,’আমরা মুসল্লিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না,
قَالُوْا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّيْنَۙ
এখন মুছুল্লীর বৈশিষ্ট কি? কাকে মুছুল্লী বলে, তার পরের আয়াতে প্রধান কয়টি বৈশিষ্ট বর্ননা করেছেন:
১)’আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করিতাম না,৭৪:৪৪وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِيْ
২) ‘এবং আমরা বিভ্রান্ত আলোচনাকারীদের সঙ্গে বিভ্রান্তি মূলক আলোচনায় নিমগ্ন থাকিতাম। ৭৪:৪৫ وَكُنَّا نَخُوْضُ مَعَ الْخَـآٮِٕضِيْنَۙ
৩)’আমরা কর্মফল দিবস অস্বীকার করিতাম, ৭৪:৪৬ وَ كُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّيْنِۙ
পরবর্তিতে সূরা আল মাউন থেকে মুছুল্লীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন:
اَرَءَيْتَ الَّذِىْ يُكَذِّبُ بِالدِّيْنِؕ
( আরায়তাল্লাযি ইউ কাজ্জিবু বুদ্দীন) তুমি কি দেখিয়াছ তাহাকে, যে দীনকে অস্বীকার করে ?
فَذٰلِكَ الَّذِىْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَۙ
( ফাযালিকাল্লাযি ইউদুউল ইয়াতিম) সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়াইয়া দেয়
وَ لَا يَحُضُّ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِؕ
(ওয়ালা ইয়াহুদ্দু আলা তা,আমিল মিছকিন)
এবং সে অভাব গ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَۙ ( ফাওয়াইলুল্লিন মুছাল্লিন) সুতরাং দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীর
الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَۙ
( আল্লাযিনা হুম আন সালাতিহুম ছাহুন) যাহারা তাহাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন,
الَّذِيْنَ هُمْ يُرَآءُوْنَۙ ( আল্লাযিনা হুম ইউরাউনা) যাহার লোক দেখানোর জন্য উহা করে
وَيَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ( ওয়া ইয়ামনা ঊনাল মাঊন)
এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট-খাট সাহায্য দানে বিরত থাকে।
এখানে মুল শব্দ ছল্লা এর অনুবাদ নামজ উল্লেখ নাই বা সালাত এর কথা বলে নাই। বলেছে আমরা মুছুল্লী ছিলাম না। আর মুছুল্লীর বৈশিষ্ট হলো রবের আদেশ নিরাবচ্ছন্ন অনুসরন করা। সালাত সর্বক্ষনিক বিরতি হীন। ৭০:২৩ মোতাবেক। এবং এটাকে সলাতুল দায়য়েমুন উল্লেখ করেছেন।
الَّذِيْنَ هُمْ عَلٰى صَلَاتِهِمْ دَآٮِٕمُوْنَ
আল্লাযিনা হুম আঁলা সালাতি হিম দাইমুন।
উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় সালাত সর্বক্ষনিক। সলাত অর্থ প্রচলিত আনুষ্ঠানিক নামাজকে বুঝায় না। সলাতের ফার্সী অনুবাদ নামাজ না বসিয়ে বাংলা অনুনাদ রবের আদেশ সমুহের নিরবাচ্ছন্ন অনুসরন বসালে সব আয়াতগুলির মর্ম বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য উপলব্ধি যোগ্য হয়। তাই নামজকে কেন্দ্র করেই মুসলমানদের মধ্যে এত এত মাযহাব উপমাযহাব। কারন কোরানে তো নামাজের স্ট্রাকচারাল গাইড লাইন নাই ই, বরং সাথে হাদীসকে যুক্ত করালেও নামাজের সর্বসম্মত স্ট্রাকচার দাড় করানো সম্ভব নয়। পরিচিত নামাজের ধারাবিবরন অতটা জটিল নয় যে কোরানে এ বিষয়ে বর্ননা দিতে অনেক আয়াত লাগতো বা হাদীসেও ডিটেইল প্রচলিত এই নামাজের ধারাবাহিক ধারা বর্ননা খুজে পাওয়া যায় না। প্রচলিত আনুষ্ঠানিক যে কোরানে নেই এ কথাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে তা কি ভাবে এ নিয়ে এর পর আলোচনা করা হবে। ইরান ইরাক অঞ্চলে প্রচলিত সালাত তিন ওয়াক্ত।
আমাদের প্রচলিত বা পরিচিত নামাজের যে আনুষ্ঠানিকতা তা কখনোই কোরান বিরুদ্ধ নয়। কোরানে সালাত শব্দটি প্রার্থনা অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছড়া দয়া, ক্ষমা প্রার্থণা,আল্লাহর দয়া,অনুগ্রহ চাওয়া, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ত মহিমা বর্ননা করার কথা কোরানে বহুববার বলা হয়েছে। নামাজের প্রতি রাকাতে আমরা সূরা ফাতিহা পড়ি। সূরা ফাতিহা সবচেয়ে মহত্ত দোয়া বা প্রার্থনা। আমাদের যতরকমের চাওয়া আছে সব আমরা নামাজে মাধ্যমেই চাইতে পারি।
কিন্তু নামাজ প্রতিষ্ঠার অর্থ মানুষকে নামাজ পড়তে বাধ্য করতে হবে, এবং সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে, পারায় মহল্লায় মাসজিদ নির্মান করতে হবে, মসজিদে জামাতে নামাজ করতে হবে, কোন অবস্থাতেই নামাজ মাফ নেই এই নির্দিষ্ট পদ্ধতিতেই নামাজ পড়তে হবে, তিন জুম্মা না পড়লে সে আর মুসলমান থাকবে না, মুসলিম আর কাফেরের মধ্য পার্থক্য হচ্ছে নামাজ, হাশরের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে,যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে তারা বেহস্তে যাবে, এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে ৮০ হোকবা দোজখের আগুনে পুড়বে, —- নামাজ নিয়ে এমন প্রচলিত ধারনা কোরান বিরুদ্ধ বা কোরান অনঅনুমোদিত।
বরং আল্লাহ — বিশ্বাস এবং সৎকর্মকে জান্নাতের পুর্ব শর্ত বলেছেন। আকিমিস সালাত বলতে আল্লাহর প্রতিটি আদেশ ও নিষেধ ছায়ার মত অনুসরন করা। অর্থাৎ ঝড়, জলোচ্ছাস, যুদ্ধ, মৃত্যু শয্যায়েও আল্লাহর বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে। নামাজ আমাদের জন্য একটি মহত্তম প্রার্থনা। নামাজে দাড়িয়ে আমরা সব আবেদন-নিবেদন,কামনা – বাসনা, রোগ-শোক, দূঃখ-বেদনা, অভাব-অনটন, জীবন- জীবিকা, সমাজ সংসারের শত শত সমস্যা সরাসরি সর্ব শক্তিমান আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করি। যত অভিযোগ – অনুযোগ, আশা- আকাংখা,ভয়-ভীতি, অজানা আশংকা পরম করুনাময়ের কাছে সমর্পন করি। সেজদায় নত হয়ে পরম দাতা দয়ালু আল্লাহর মহত্ত,শ্রেষ্ঠত মহিমা গাই। সব ভুল-ভ্রান্তি, পাপ-তাপের ক্ষমা চাই অসীম ক্ষমাশীল স্রষ্টার কাছে। মহা জ্ঞানী মহাপ্রভুর কাছেই চাই সাহায্য, শক্তি -সাহস ও সত্য পথের দিশা। যত রকমের দোয়া দাবী আছে সবই নিবেদন করি নামাজে।
নামাজ হচ্ছে আত্মশুদ্ধির পথ, আত্ম উন্নয়নের সিড়ি। এই নামাজ বা প্রার্থনায় সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে মনের একাগ্রতা। নামাজের মাধ্যমেই যুক্ত হচ্ছি মহাশক্তিমান, মহা প্রভুর সাথে। প্রার্থনা যোগে সর্ব শক্তিমানের সাথে সংযোগ সংস্থাপনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম নামাজ।
আমি আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতেই নামাজ পড়ি। কারন এতে আমি অভ্যস্থ, এতেই আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কিন্তু নামাজের এই পদ্ধতি,প্রক্রীয়া এবং নামাজের এই প্রচলিত ধারনা কোরান বিধিত,নির্ধরিত বা চুড়ান্ত নয়। কিন্তু তিন অবস্থায় নামাজ আদায় করা যাবে না তা কোরানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে।
হে ঈমানদারগন তোমরা প্রার্থনার নিকটবর্তী হয়ো না, ১) নেশা গ্রস্থ অবস্থায় ২) যতক্ষন না বুঝতে পারছো তোমরা কি বলছো ৩) অবিপ্র অবস্থায়। আল্লাহ অন্তর্যামী। তাই আল্লাহকে যা বলবেন তা হতে হবে মনের কথা।
নামাজে দাড়িয়ে বলছি:
সরল সঠিক পুন্যপন্থা দাও গো মোদের বলি
চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি
এই সরল সঠিক পুন্য পন্থা হচ্ছে কোরান। কিন্তু নামাজে দাঁড়িয়েও যদি স্মরণ করি জটিল, কঠিন, ভেজাল পন্থা
তবে এ নামাজ শুধু অর্থহীনই নয় এ নামাজ আমাদের নিয়ে যাবেঃ —
যে পথে তার চির অভিশাপ, যে পথে ভ্রান্তি চির পরিতাপ।
এ কারনেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া অনেককেই দেখি কোরানে নিষিদ্ধ অসৎ অপকর্মে ডুবে থাকতে।