রবের বাণী থেকে বিচ্যুত মানুষ আজকের দিনে অধিকাংশ মানুষ মোল্লার কথায় অন্ধ বিশ্বাস রাখে,কিন্তু যখন আল্লাহর কালাম তুলে ধরা হয়, তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। চৌদ্দশ বছর ধরে চলছে এই লড়াই— আল্লাহর প্রকৃত রসূলের সত্য বার্তা আর বুখারীর মনগড়া বাণীর সংঘর্ষ। ফলশ্রুতিতে মুসলমানরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, আর কুরআনের চিরন্তন আলো ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে দশটি হাদিসের অন্ধ গলিতে।
জ্ঞানের নামে অজ্ঞতা
যে মুখে কুরআনের কথা উচ্চারিত হয়,সেই মুখকেই ধর্মের জ্ঞানীরা বলে— অজ্ঞ, উম্মাদ, মূর্খ। কারণ, তাদের জ্ঞান কাগজে বন্দী, আর স্রষ্টার জ্ঞান উন্মুক্ত আকাশের মতো সীমাহীন। মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয় যেন কবরের মৃতদের মতো— তাদের কান কুরআনের সত্য শুনতে পায় না, কারণ তাদের শেখানো হয় অক্ষর, শেখানো হয় উচ্চারণ, কিন্তু শেখানো হয় না অর্থ, শেখানো হয় না বোধ।
সত্যিকারের ইসলামী নেতৃত্ব
ইসলামের নেতা হবেন তিনি— যিনি নিজের জন্য কম, কিন্তু মানুষের জন্য বেশি চান। যিনি সম্পদের প্রাচুর্যে নয়, বরং আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ এক সাধারণ জীবনকে আদর্শ মানেন। যিনি লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে, দিনের আলো নিভে গেলে রাতের নীরবতায় মানুষের মুক্তির কথা ভাবেন। যিনি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানান মহা সত্যের পথে,আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই যাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য— তিনিই হচ্ছেন আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রকৃত প্রতিনিধি।
জ্ঞানের আসল মানদণ্ড
ইংরেজি জানলেই কেউ শিক্ষিত হয় না,আরবি জানলেই কেউ মুমিন হয় না। আমেরিকার ভাষা ইংরেজি— তবু সেখানে অসংখ্য অজ্ঞ মূর্খ আছে। সৌদির ভাষা আরবি— কিন্তু সেখানেও আছে কাফের, মুনাফেক, মুশরিক। তাহলে ইসলামের মানদণ্ড কি? না সৌদি, না কোনো মানুষ—ইসলামের মানদণ্ড একমাত্র আল-কুরআন ও কাবা। তাই নিজের মাতৃভাষায় কুরআন পড়ুন, বুঝুন, জানুন ও প্রচার করুন।যারা সত্য বুঝে, সত্য মানে—তারা-ই শিক্ষিত, তারা-ই জ্ঞানী, আর তারাই শান্তির রাজ্যের অধিবাসী।
ধর্মের বাণিজ্য
যখন কুরআন পরিত্যক্ত হয়, তখন ইমাম-হুজুরদের টিফিন ক্যারিয়ার ঘুরে বেড়ায় ধনী-দরিদ্র সবার ঘরে। সুদখোর, ঘুষখোর, প্রতারকের বাড়ির খাবারও “সুবহানাল্লাহ” বলে গিলতে থাকে ধর্মগুরুদের পেট। যে সত্য বলে না, যে সত্য ধারণ করতে ভয় পায়, সে-ই তো শয়তানের দোসর।
আল্লাহর হুকুম ও কুরআনের সার্বভৌমত্ব
আল্লাহকে কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু তাঁর হুকুম আমরা পাই তাঁর বাণীতে—আল-কিতাবে, আল-কুরআনে। তাঁর কালামের সঙ্গে কাউকে শরিক করা মানে তাঁর সার্বভৌমত্বে শরিক করা। এ কারণেই তিনি সতর্ক করে বলেছেন— যে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, বরং মানুষের বানানো বিধানে ফায়সালা দেয়, তারা-ই কাফের, জালেম ও ফাসেক। (সূরা আল-মায়িদা ৫:৪৪–৪৭)
কুরআন— রবের একমাত্র পথনির্দেশ
আমাদের দেশে কুরআন শেখানো হয়,কিন্তু শেখানো হয় শুধু অক্ষর, নয় অর্থ।তাই কুরআন তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনে না। আল্লাহ বলেন— যে ব্যক্তি আমার আয়াত পেয়েও তা ত্যাগ করে, সে শয়তানের পথে চলে যায়। সে হয়ে যায় সেই কুকুরের মতো, যাকে বোঝা দাও বা না দাও—সে হাপরের মতো হাঁফাতে থাকে (সূরা আ’রাফ ৭:১৭৫–১৭৮)।
কুরআন— সকলের জন্য উন্মুক্ত
কুরআন কারও বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়।এটি আল্লাহর রাসূলের ছাত্র হয়ে বোঝা যায়, কারণ তিনিই পাঠ করেছেন, শিখিয়েছেন, এবং মানব জাতিকে শুদ্ধ করেছেন (সূরা ইমরান ৩:১৬৪)।
উপসংহার
আল্লাহ বলেন— “এই পথই আমার সরল পথ। এই পথই অনুসরণ করো।” (সূরা আন’আম ৬:১৫৩) যে এই পথে চলে, সে মুক্তি পায়। যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে নিজেই নিজের ক্ষতির কারণ হয়। সত্য কষ্টের হতে পারে, কিন্তু মুক্তিরও একমাত্র রাস্তা। তাই ফিরে আসো— কুরআনের দিকে, রবের দিকে, যে পথ আলোকিত করে হৃদয়, জাগায় বিবেক,আর নিয়ে যায় রবের শান্তির রাজ্যে।
“সরল পথ কোরআন — পীর নয়”
কোরআনে ডজন ডজন আয়াত ঘোষণা করে — “সরল পথ আমি দেখাই, পীর নয়, প্রথা নয়।” কিন্তু মানুষ আজও মাটির তৈরি দেবতার পায়ে, কিংবা মানুষের তৈরি পীরের দরজায় সেজদা খোঁজে।(৩৩:৬৬-৬৮)
আগুনে মুখ থুবড়ে পড়বে তারা, বলবে —
“হায়! যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম,
আর তাঁর রসূলের কথায় কান দিতাম!”
তখন তারা স্বীকার করবে —“হে আমাদের রব! আমরা তো আমাদের পীরদের,
সাদাতদের, নেতাদের কথায় মগ্ন ছিলাম।
তাদের অনুসরণেই আমরা কুরআনের পথ হারিয়েছি। হে রব! তাদের দ্বিগুণ আযাব দাও, আর তাদের দাও এক ভয়ংকর অভিশাপ।”“কুরআনের শত্রু — মনগড়া ধর্ম”
মানুষ আজ কুরআনের নয়, বরং হাদিসের পৃষ্ঠায় ধর্ম খোঁজে। দশটি “সেটানিক হাদিস” নাকি বিচার দিবসের চিত্র বলে, যেখানে মানুষকে নগ্ন করা হবে, ঘামে ডোবানো হবে,
কেউ হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত, কেউ পাবে ৫০ হাজার বছরের অপেক্ষা — কিন্তু কুরআন বলে ভিন্ন কথা।(২২:৪৯-৫৭)
“শোনো মানবজাতি! আমি তো তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী। যারা ঈমান আনে ও সংশোধন করে, তাদের জন্য ক্ষমা ও সম্মান জনক রূজি রয়েছে। আর যারা আমার আয়াতকে অবমাননা করে, তাদের জন্য থাকবে সংকীর্ণ শাস্তির আগুন।…একদিন আসবে, যখন সব রাজত্ব কেবল আল্লাহরই হবে, আর ন্যায়বিচার হবে তাঁর বিধানেই।”
বুখারীর ধর্ম নয় — কুরআনের দ্বীন”
আজ ইসলামকে বানানো হয়েছে বুখারীর ধর্ম।
কুরআনের জীবনব্যবস্থা ছুড়ে ফেলে মানুষ ঢুকে গেছে শিয়া–সুন্নি–সালাফি বিভাজনের কারাগারে। ফলে আজ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে মুসলমান তুচ্ছ, কারণ তারা ভুলে গেছে —
ইসলাম কোনো ধর্ম নয়, ইসলাম একটি দ্বীন, একটি জীবনব্যবস্থা।
কুরআন মানুষের জীবনের নির্দেশিকা,কিন্তু আমরা একে বানিয়েছি সুরে তেলাওয়াতের বই। পড়ি, কিন্তু বুঝি না; শুনি, কিন্তু মানি না।
“ধর্ম নয়, কুরআনের সত্য জীবনবোধ”
ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে —
কুরআন মানুষকে যুক্ত করে।
ধর্মের নামে যুদ্ধ হয়,কুরআন বলে — শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো।ধর্ম শেখায় অন্ধ আনুগত্য,কুরআন শেখায় যুক্তি, জ্ঞান, ও বাস্তবতা।ধর্মান্ধতা জন্ম দেয় নাস্তিকতা,কিন্তু কুরআন জাগায় চিন্তার আলো —যা মানুষকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনে।
⚖ “অন্যায়ের সমাজে কুরআনের আবেদন”
যখন ক্ষমতা অযোগ্যদের হাতে যায়, যখন বিচার হয় টাকায়, যখন দুর্নীতিবাজ সম্মান পায়,তখন মজলুমের কান্না ওঠে আকাশে —
“হে আল্লাহ! আর কত?”
কিন্তু কুরআন ঘোষণা করে —মানুষের আদালতে যদি ইনসাফ না মেলে,তবে একদিন আল্লাহর আদালতে প্রত্যেক অন্যায়ের বিচার হবেই।
“ধর্ম নয়, কুরআনই মুক্তির পথ”
(১৬:৯০) “আল্লাহ ন্যায়, সৎকর্ম ও দানশীলতার আদেশ দেন,আর নিষেধ করেন অন্যায়, অশ্লীলতা ও বিদ্বেষ থেকে।”
কুরআনই মানুষকে শেখায় পাপের সংজ্ঞা,
যা আত্মাকে কলুষিত করে,যা সমাজের সৌন্দর্য নষ্ট করে।
কোনো ধর্মই মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারেনি,বরং ধর্মের নামে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ,
রক্তপাত, মতভেদ, অন্ধ আনুগত্য।কিন্তু কুরআন আহ্বান জানায় —
“এক স্রষ্টা, এক মানবতা, এক ন্যায়ব্যবস্থা।”
“সত্য কুরআনে, বিভেদ মানুষের”
যদি মুসলমান ঘরে জন্ম মানেই জান্নাত হয়,
তবে অন্য ধর্মে জন্ম মানেই কি জাহান্নাম?
স্রষ্টা তো একজন, তাঁর দয়া তো সীমাহীন।
তাহলে কেন এত বিভেদ? কেন কেউ মসজিদে, কেউ মন্দিরে, কেউ গির্জায় খোঁজে তাঁকে?
সত্য এ নয় যে সব ধর্মই সঠিক —সত্য হলো, কোন ধর্মই পূর্ণ নয়, সত্য শুধুই সেই কুরআনে,
যা এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। “কুরআন — প্রকৃতির ভাষা”
আল্লাহর বিধান প্রকৃতির মতোই অপরিবর্তনীয়।
বায়ু, জল, আলো — যেমন নিয়মে চলে, তেমনি চলে স্রষ্টার ন্যায় ও বিধান।
(৬:১১৫) “তাঁর কালিমার কোনো পরিবর্তন নেই।”
ওহি হচ্ছে অনুপ্রেরণা,যা নবীরা তাঁদের ভাষায় প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এর মর্ম অমলিন,
কারণ সেটি আল্লাহর নিয়মের প্রতিফলন।
তাই কুরআনকে বুঝতে হলে তৎকালীন আরবের সমাজ, ইতিহাস, ও বাস্তবতা জানতে হয়,যেমন জানতে হয় মানব সভ্যতার বিবর্তন।
পৌত্তলিক ধর্মঃ
প্রাক-ইসলামী আরবে মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্র ছিল অসংখ্য দেব-দেবীর পূজায়।
তাদের প্রধান দেবতা ছিল হুবাল, সিরীয় চাঁদের দেবতা। হুবালের ছিল তিন কন্যা—
১) আল-লাত – মক্কার প্রধান দেবী, পাতাল ও উর্বরতার সঙ্গে যুক্ত।
২) আল-উজ্জা – সর্বশক্তিময়ী, যুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক; যাকে যুদ্ধে নামার আগে আহ্বান জানানো হত।
৩) আল-মানাত – ভাগ্যের দেবী, যাকে “সমস্ত মূর্তির মধ্যে প্রাচীনতম” বলা হয়েছে (বুক অফ আইডলস অনুযায়ী)।
এদের পাশাপাশি আরও বহু দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল—
ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসর—
প্রত্যেকেই কোনো না কোনো উপজাতির রক্ষাকর্তা দেবতা হিসেবে সম্মান পেতেন।
এসব দেবতার জন্য তারা কাবার অনুকরণে সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করত, নিয়োগ করত পাহারাদার ও দারোয়ান, এবং উৎসর্গ করত নানান হাদিয়া ও উপঢৌকন। (71:23–24)
তাদের ইবাদতের রীতিঃ
মূর্তিপূজার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত আচারনির্ভর।
তারা দেবতাদের চারপাশে জড়ো হয়ে বসত, উচ্চস্বরে নাম ডাকত,দুঃসময়ে সাহায্যের আবেদন করত—
বিশ্বাস করত, এই মূর্তিগুলো আল্লাহর কাছে তাদের পক্ষে সুপারিশ করবে।
হজ ও তাওয়াফ ছিল তাদের ধর্মীয় অনুশীলনের অংশ।
তারা মূর্তির চারপাশে ঘুরে বেড়াত, মাথা নত করে সালাম জানাত, আর সাফা ও মারওয়া, আরাফাত, মিনা ও মুজদালিফায় তীর্থযাত্রা করত।
প্রতিটি স্থানেই কোনো না কোনো দেবতার স্মৃতি ও প্রতীক লুকিয়ে ছিল।
তারা পশু কোরবানি দিত, ফসল ও গবাদি পশুর একটি অংশ দেবতাদের জন্য নির্ধারিত রাখত।
তাদের ভাগ্যনির্ধারণে ব্যবহৃত হত “আজলাম” নামের তীর,
যা কখনো জুয়া ও ভবিষ্যদ্বাণীতেও কাজে লাগানো হতো।
তারা গণক, জ্যোতিষী ও কুসংস্কারে অগাধ বিশ্বাস রাখত।
শিরক ও মূর্তি পূজা ছিল তাদের ধর্মীয় জীবনের মূল প্রতীক।
ইহুদি ধর্মঃ
ইহুদি ধর্ম ছিল প্রাচীনতম একেশ্বরবাদী বিশ্বাস ব্যবস্থা গুলির একটি।
প্রাক-ইসলামী আরবে বহু ইহুদি উপজাতি সমৃদ্ধ জীবন যাপন করত—
কিছু ছিল স্থানীয়, কিছু যাযাবর।
রোমান আমল থেকেই ইহুদিরা আরবে বসতি গড়ে তোলে।
আরবীয় ইহুদিরা আরবি, হিব্রু ও আরামাইক—এই তিন ভাষায়ই দক্ষ ছিল, এবং ব্যাবিলন ও ফিলিস্তিনের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
৪র্থ শতাব্দীতে ইয়েমেনের হিমিয়াররা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে,
তাদের প্রভাবে মধ্য আরবের কিছু কিন্দাহ উপজাতিও ধর্মান্তরিত হয়।
মদিনা (ইয়াসরিব)-এর ইহুদি ও আরব জনগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থানে ছিল।
ইয়াসরিবের কিছু আরব নারী তাদের সন্তানদের জীবনরক্ষার মানত হিসেবে ইহুদি বানানোর প্রতিশ্রুতি দিতেন, কারণ তারা ইহুদিদের “জ্ঞান ও কিতাবধারী জাতি” বলে মনে করত।
ইহুদি কৌমগুলোর মধ্যে ছিল —
বনু খাইবর, বনু নজির, বনু মুস্থালিক, বনু কাইনুকা, এবং বনু কুরাইজা।
খ্রিস্টধর্মঃ
৩২৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন বাইজান্টিয়াম জয় করার পর খ্রিস্টধর্ম আরবে প্রবেশ করে।
এই ধর্ম গ্রহণ করে হিমিয়ার, গাসান, রাবিয়া, তাগআব, বাহরা, তুনুখ, তাই ও খুদা’র কিছু উপজাতি, তাছাড়া নাজরান ও হীরার বাসিন্দারাও এতে দীক্ষিত হয়।
ইহুদি ও খ্রিস্টান—উভয়েই ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখত। উত্তর-পশ্চিম আরব ছিল রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাবাধীন, দক্ষিণে ইয়েমেন ও নাজরান অঞ্চল ছিল ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান রাজ্য অ্যাক্সাম-এর প্রভাবে।
গাসানাইড ও দক্ষিণের অনেক খ্রিস্টানই মনোফিজিটিজম মতবাদ গ্রহণ করে। তবে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে নবী মুহাম্মদের (সা.) উত্থানের পর আরবে খ্রিস্টধর্মের বিস্তার থেমে যায়।
ইরানি ধর্ম ও আরবের মানসিক দৃশ্যপট
পারস্যের ছায়া খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে, পারস্য উপসাগর ও দক্ষিণ আরবে সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল গভীর।বাণিজ্যের সোনালি পথ ধরে পারস্যের সংস্কৃতি ও ধর্ম এসে মিশেছিল আরব উপদ্বীপে।হেজাজ ও ইরাকের মধ্যবর্তী এই বাণিজ্যপথ শুধু পণ্য নয়, বহন করেছিল বিশ্বাস ও চিন্তার আদান প্রদান।
উত্তর-পূর্ব আরবে কিছু মানুষ রূপান্তরিত হয়েছিল জরথুস্ত্রীয় ধর্মে,নজদের মরুভূমিতে উঠেছিল একের পর এক আগুনের মন্দির —
জরথুস্ত্রের জ্বলন্ত শিখা সেখানে মানুষের আত্মায় আলো জ্বালিয়েছিল,যদিও অনেকের জন্য তা ছিল ভয়ের প্রতীকও।
বনু তামিম গোত্রের কিছু সদস্য পরবর্তীতে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল,
তবে তখনও আরবে বিদ্যমান ছিল পারস্যের প্রাচীন ধর্ম, ম্যানিচেইজম ও মাজদাকিজম-এর ছায়া।ইতিহাসবিদ ট্রম্পফ ও মিকেলসেনের মতে, এই সময়েই মক্কায় ম্যানিচেইজমের চিন্তাধারার কিছু প্রভাব দেখা গিয়েছিল—
মানুষ তখন সত্যের সন্ধানে দ্বিধাবিভক্ত,
কেউ আলোর উপাসক, কেউ বিভ্রান্ত অন্ধকারের পূজারী।
পারস্য থেকে আরব পর্যন্তঃ
জরথুস্ত্রবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল বাহরাইন, ওমান ও ইয়েমেন পর্যন্ত।খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে পারস্য সাম্রাজ্যের শাসনে এই অঞ্চলগুলো হয়ে উঠেছিল অগ্নিপূজার কেন্দ্র।পারস্যের বসতি স্থাপনকারীরা বাহরাইন ও ওমানে তাদের উপাসনা প্রচলিত করে,আর ইয়েমেনে পারস্য বিজেতাদের বংশধরেরা আবনার নামধারী পরিবারগুলোর মাধ্যমে এই ধর্মের অনুশীলন চালিয়ে যায়।
এভাবে ইসলামপূর্ব আরবের ধর্মীয় মানচিত্রে একসঙ্গে টিকে ছিল—চন্দ্রদেব হুবাল, ইহুদিদের ইয়াহওয়ে, খ্রিস্টানদের মসীহ,
এবং পারস্যের আহুরা-মাজদা।এ যেন ছিল বিশ্বাসের এক গোধূলিলগ্ন—যেখানে আলোর রঙে রঙিন ছিল আকাশ,কিন্তু মনুষ্যহৃদয় ছিল ছায়ার আচ্ছাদনে।
সমাজের অবস্থা — নারীর চোখে এক আরব
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আরব ছিল গোত্রবদ্ধ সমাজ।এক গোত্রের রক্ত অন্য গোত্রের শত্রু,
এক মেঘের তৃষ্ণা অন্য মেঘের বজ্র।
নারীরা ছিল সেই সমাজে অধিকারবঞ্চিত ছায়া।বাবারা কন্যাদের বেচে দিত সামান্য মূল্যে,স্বামীরা ইচ্ছেমতো ত্যাগ করত,নারীর কোনো উত্তরাধিকার ছিল না,শুধু মাতৃত্বই ছিল তাদের একমাত্র মর্যাদা।
তবু মরুভূমির এই অন্ধকারে কিছু তারকা নারী জ্বলজ্বল করেছিল— যারা উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মে সম্পদ উত্তরাধিকার করত,মর্যাদা পেত,আর নিজেদের অন্তরাল ঢাকা দিত ঘোমটার গাম্ভীর্যে।বাইজেন্টাইন ও পারস্যের অভিজাত নারীদের মতোই,আরবের উচ্চবিত্ত নারীদের পর্দা ছিল সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীক।রাসূলে কারীম ও কুরআনের আহ্বান
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—রাসূলে কারীম (সাঃ) কি কখনও কুরআনের বাইরে কোনো ওহী অনুসরণ করেছেন?
কুরআন নিজেই বলে— না।
(৬:৫০) “আমি তো শুধু তাই মেনে চলি, যা আমার কাছে ওহী হয়ে পৌঁছে।”
(৪৬:৯) “আমি নতুন কোনো রাসূল নই; আমি তো কেবল সেই ওহী অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে।”
(২:৭৮–৭৯) “যারা নিজেদের হাতে কিতাব লিখে, তারপর বলে— ‘এটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে,’তাদের জন্য ধ্বংসই নির্ধারিত।”
এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে —
রাসূলে কারীম ছিলেন কেবল কুরআনের আনুগত্যে নিবেদিত,আর তাঁর অনুসারী হওয়া মানে কুরআনের অনুসারী হওয়া,মানুষের তৈরি বই বা হাদিসের নয়।
আজ পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের মনে দুটি চিত্র
একজন ইতিহাসের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ,
অন্যজন কুরআনের মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
ইতিহাসের মুহাম্মদ মানুষ ছিলেন,চার পুত্র ও চার কন্যার জনক,যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
কিন্তু কুরআনের মুহাম্মদ —তিনি চিরজীবিত বার্তাবাহক,যিনি আজও আয়াতের মাধ্যমে জীবিত আছেন।
(৩৩:৪০) “মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন,বরং তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল,সকল নবীর সীলমোহর।”
রাসূলের সত্য পরিচয়
কুরআন বলে, আল্লাহর রাসূল কোনো জাতি বা স্থানের সীমায় আবদ্ধ নন।তিনি সমগ্র মানব জাতির জন্য পাঠানো হয়েছেন।
(৭:১৫৭–১৫৮) “যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাঁকে সাহায্য করে,আর তাঁর সঙ্গে পাঠানো আলোকিত কিতাব অনুসরণ করে তারাই সফল।”
তিনি “রহমাতুল্লিল আলামিন”—সকল জগতের জন্য রহমত,কোনো নির্দিষ্ট শহরের, জাতির, বা বংশের নয়।মনগড়া ধর্ম ও মিথ্যা রাসূল
কুরআন সতর্ক করে—“যে আল্লাহর বিধান নয়, মানুষের তৈরি নিয়মে ফয়সালা দেয়,
সে জালিম, সে কাফের।” (৫:৪৪–৪৭)
আজ পৃথিবীতে শিয়া–সুন্নি–সালাফি–আহলে হাদিস—
এইসব নাম কেবল বিভেদের দেয়াল।যারা হাদিসকে কুরআনের উপরে রাখে, তারা নিজেরাই কুরআনের আলো থেকে দূরে সরে যায়।
